সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০ ২২:৩৫ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব)সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন।

তিনি করোনাসহ পুলিশের বিভিন্ন ভালো কাজের প্রশংসা করেছেন। তবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। পুলিশের এসব ঘটনা বন্ধের জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি সিনহা হত্যা প্রসঙ্গে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাজে একধরনের ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য যেমন হুমকি তেমন সুশাসনের জন্যও হুমকি। 

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। 

রেডিও তেহরান: জনাব নূর খান লিটন, বাংলাদেশে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সাবেক একজন মেজরকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি নুর খান লিটনের

নুর খান লিটন: দেখুন, গত প্রায় পনের বছর ধরে আমরা দেখছি একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। যদিও এর সংখ্যাগত হিসাবটা নিশ্চিত করে না বলা গেলেও প্রায় চার হাজারের মতো মানুষ এরইমধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আর সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর অব. মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান কক্সবাজারের পুলিশ চেক পোস্টে এই ধরনের একটি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এরপর আমরা কক্সবাজারের ঐ অঞ্চলে লক্ষ্য করছি গত দেড় দুই বছরে প্রায় ১৮০ থেকে ১৯০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। তার বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছেন টেকনাফ থানাধীন এলাকায়। আপনি জানেন যে, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমাদের দেশে গত দেড় দুই বছরে প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা বারবার সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেছেন দাবি জানিয়েছেন যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হোক। ক্রসফায়ার, বন্দুকযু্দ্ধ কিংবা এনকাউন্টারের নামে-যে নামে নামেই হোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হোক। এটি বন্ধ করা দরকার এবং তদন্ত কমিশন গঠন করে যারা এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন প্রতিটি ঘটনার তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ার জন্য সুপারিশ করবে।

রেডিও তেহরান: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে আপনি তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলছিলেন। তো মেজর (অব)সিনহা মো.রাশেদ হত্যাকাণ্ডসহ মোটামুটিভাবে আপনি একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। তো এসব ঘটনার আলোকে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

নুর খান লিটন: দেখুন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো এটা বলার সুযোগ নেই। তারপরও এটা স্পষ্ট যে যতটা বিশৃঙ্খলা সন্ত্রাসীদের দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে তারচেয়ে বেশি আমরা লক্ষ্য করছি এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাজে একধরনের ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য যেমন হুমকি তেমন সুশাসনের জন্যও হুমকি। 

সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ

বাংলাদেশের সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অন্তত একজনের কথা বলছি যিনি সিনহা হত্যাকাণ্ডের ২ নম্বর আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার। তিনি নিজে বিভিন্ন জায়গায় পাবলিক মিটিং এ বলেছেন, যারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত বা ব্যবসা করছে তাদের নাম আপনারা দেন আমি তাদের বিচার করব ক্রসফায়ারে দিয়ে। এই যে কথাগুলো সাবেক ওসি প্রদীপ বলেছেন, তার একথার মধ্য দিয়ে মোটমুটি বলা যায় দেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর এ ধরণের কথা বলার পরও পুলিশ বিভাগের কোনো কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা জিজ্ঞাসাবাদ কিছুই করেন নি এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের তরফ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত আমরা নিতে দেখি নি। ফলশ্রুতিতে মেজর সিনহার মতো মানুষরাও এ ধরণের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন।

তারপর আরও দুর্ভাগ্যজনক এবং আমাদের শঙ্কিত করে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের যারা আইন তৈরি করেন, যারা সংবিধান রক্ষা করবেন সেই পার্লামেন্ট সদস্যরা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছেন। আইন প্রণেতারা যখন এই ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেন সেটা আসলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আর পুলিশ এত মাত্রায় তারা পাওয়ার এক্সারসাইজ করছে..

রেডিও তেহরান: জনাব নুর খান লিটন-  আমি পুলিশ প্রসঙ্গেই জানতে চাচ্ছি- পুলিশ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে বিভিন্নমহলে। অনেকে বলছেন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে যেখানে পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকা থাকার কথা সেখানে পুলিশ হেফাজতে অথবা পুলিশের উদ্যোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞ মহলের কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

নুর খান লিটন: দেখুন, পুলিশ এই ধরনের অবস্থায় একটি রাষ্ট্রে তখনই যেতে পারে যখন সেই রাষ্ট্র বা দেশ যারা পরিচালনা করেন-তারা পুলিশকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিককালে আমরা পুলিশকে এমনও কথা বলতে শুনেছি যে, আমরাই তো ক্ষমতায় এনেছি। আমরাই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছি সেই দাপটে সারা বাংলাদেশে বর্তমানে একধরনের পুলিশি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এটি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে।

রেডিও তেহরান: জনাব নূর খান লিটন, এ প্রসঙ্গে আরেকটু যোগ করব,  মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত বলে প্রাথমিক খবরাখবর থেকে জানা যাচ্ছে। তো প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এই অবস্থায় তৈরি হয়েছে? এর অবসান হবে কিভাবে?

Image Caption

নুর খান লিটন: দেখুন, এটি হয়েছে তাদের চেইন অব কমান্ডের ক্রুটি-বিচ্যুতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা পুলিশকে তাদের মতো করে ব্যবহার করতে চাওয়ার কারণে পুলিশও ‘পুলিশের’মতো কাজ করছে। কোনো কোনো পুলিশ ক্রসফায়ারকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আবার এটাও ঠিক বাংলাদেশের পুলিশ করোনাসহ অন্যান্য দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশের ভেতরে চেইন অব কমান্ডের ক্রুটি বিচ্যুতি ও দুর্বলতা থাকার কারণে এই ধরনের ঘটনাও কিন্তু পুলিশ ঘটাচ্ছে। কখনও কখনও কোনো ব্যক্তিকে খুশি করার জন্য যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে।

আর এসবের অবসানের জন্য যে কাজটি খুব জরুরিভাবে করা দরকার তা হচ্ছে, একটি স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করা খুবই জরুরি। সেই কমিশনে অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি, বিচারপতি, সাংবাদিক,আইনজীবী এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যুক্ত হতে পারবেন বা তাদেরকে নিয়ে এই কমিশন গঠন করতে হবে।

কমিশনের কাজ হবে পুলিশের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নিয়োগ, পদোন্নতি সবই থাকবে। এমনকি পুলিশের মধ্যে যদি কোনো স্খলন ঘটে যেমন ধরুন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-এমন ঘটনায় যদি পুলিশ যুক্ত হয় তাহলে সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান করে  পুলিশ বাহিনীকে এবং রাষ্ট্রকে পরামর্শ দেবে কমিশন। যাতে তারা সংশোধন হতে পারে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে সেই ধরনের সুপারিশ তারা করবেন। সেটি যদি করা যায় তাহলেই পুলিশ একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে আসবে। পুলিশ বাহিনীর বর্তমান  এ অবস্থার সংস্কার করা ছাড়া তাদের পক্ষে জনগণের আস্থা অর্জন করার সুযোগ নেই।

করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশের প্রশংসনীয় কার্যক্রম

আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি পুলিশ কল্যাণ সমিতিসহ তাদের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এবং মিডিয়াতে পুলিশ সম্পর্কে অনেক বেশি নেগেটিভ প্রচার করা হচ্ছে এবং তারা দেশের পুলিশ ও সেনা বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি তা না। বিষয়টি হচ্ছে- পুলিশের ভেতর যেসব ক্রটি বিচ্যুতি আছে সেগুলোকে যেমন আমরা চিহ্নিত করতে চাই এবং সেসব বিষয়কে বিচারের আওতায় আনার কথা বলছি পাশাপাশি দৃশ্যত পুলিশ যেসব ভালো কাজ করছে যেমন- এর আগে বলেছি করোনাকালে পুলিশের কর্মকাণ্ড এবং আরও অনেক সময় পুলিশের ভালো কাজকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই।

রেডিও তেহরান: তো জনাব নূর খান লিটন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর অব. সিনহা মো.রাশেদ হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আবারও আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

নুর খান লিটন: আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৮

  • বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ