প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) পর্ব-১৫
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, রুশ কবি ইভান অ্যালেক্সেভিচ বুনিন ছিলেন বিংশ শতকে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে গবেষণাকারী নিরপেক্ষ পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। তিনি তার কবিতায় ইসলাম ও মহানবীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মক্কা থেকে মদিনায় মহানবীর (সা) হিজরতের ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ‘'খোঁজা হচ্ছে মুহাম্মাদকে (বন্দি করার জন্য) '’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন:
তিনি / ছোট ছোট পাথরের নুড়ির ওপর বসেছিলেন/ খালি পায়ে/
তার বক্ষ ছিল খোলা/ এবং বিষণ্ণ সুরে তিনি বলছিলেন:
প্রান্তর ও মরুভূমির দৃশ্যের দিকে তাকালাম/ সবার কাছ থেকে আলাদা হলাম
যাদের ভালবাসতাম!/এবং ফেরেশতারা বা আত্মাগুলো বলল:
নবীর উচিত নয় ক্লান্ত ও মন-ভাঙ্গা হওয়া
এবং নবী দুঃখিত ও প্রশান্ত চিত্তে জবাব দিলেন:
আমি পাথরের কাছে নালিশ করছি!
রুশ কবি বুনিনের মতে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসাই মানুষকে দেয় অকৃত্রিম আনন্দ। তার কবিতায় প্রকৃতির মনোহর দৃশ্যাবলী খুব দক্ষ হাতে ও শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বুনিনের একটি গল্পের নাম হোমা পাখির ছায়া। পবিত্র কুরআনের আয়াত ব্যবহার করে এই গল্পে তিনি বিশ্ব-জগত সম্পর্কে নিজের ভাবনা ও বিশ্বাস তুলে ধরেছেন। মহান ইরানি কবি শেখ সা'দির কবিতা থেকে প্রেরণা নিয়ে তিনি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন সৃষ্টির রহস্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে। এভাবে বুনিন এমনসব নতুন ভাবনা ও বিশ্বাসকে তুলে ধরতে পেরেছেন যা অতীতের রুশ কবিরা পারেননি। বুনিন ছাড়া অন্য কোনো রুশ কবি এত বেশি মাত্রায় ইসলামী ও পূর্বদেশীয় কবিতা লেখেননি।

রুশ কবি ইভান বুনিন নিজের সঙ্গে পবিত্র কুরআন রাখতেন ও কুরআন অধ্যয়নকে তিনি নিজের জন্য বেশ জরুরি কাজ বলে মনে করতেন। রুশ ভাষায় নিকোলায়েভের অনুবাদ করা পবিত্র কুরআন সফরের সময়ও তার সঙ্গে থাকত। তার স্ত্রী ইসলামের প্রতি নিকোলায়েভের গভীর ভালবাসার কথা তুলে ধরতে গিয়ে নিজ ডায়েরিতে লিখেছেন: ইসলাম নিকোলায়েভের খুব গভীরে প্রবেশ করেছিল।
রুশ কবি ইভান বুনিনের আরেকটি বড় লেখা হল ‘মহানবীর মৃত্যুর কাহিনী। তার এই লেখাটি দর্শন, প্রজ্ঞা ও খোদাপ্রেমের আলোয় প্রদীপ্ত। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম শীর্ষক বাক্যটি দিয়ে শুরু করেছেন তিনি এই লেখা। এ বইটি লিখে বুনিন খোদার পরিচয় ও জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পাঠক সমাজকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আল্লাহ থেকে দূরে থাকা ও মহান আল্লাহর সত্ত্বাকে অনুভব না করা মানুষের নিজেরই ত্রুটি। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, আমরা আল্লাহকে খালি চোখে দেখিনি ও দেখতে পারি না। কিন্তু সূর্যকে বাদুর দেখতে পায় না বলে তা সূর্যের ত্রুটি নয়।
মহান আল্লাহকে বোঝাতে বুনিন তার লেখায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বাক্যটি ছাড়াও মহান আল্লাহর দুই গুণবাচক নাম রাহমান ও রাহিম শব্দগুলোও বার বার ব্যবহার করেছেন। তিনি মহানবীর মৃত্যুর কাহিনী শীর্ষক বইয়ে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বাক্যটি দুই বার এবং রাহমান ও রাহিম শব্দ দুটিও দুই বার ব্যবহার করেছেন। ফলে রাহমান ও রাহিম শব্দ দুটি মোট চারবার ব্যবহৃত হয়েছে তার এ বইয়ে।
মুসলমানদের পবিত্র বিষয়গুলো ও প্রথা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান ছিল বুনিনের। মুসলমানদের কাছে সবুজ রং যে খুব প্রিয় ও এ রং যে পবিত্রতার এবং বিশেষ করে মহানবী (সা) ও তাঁর বংশধরদের প্রতীক সে বিষয়ে তিনি ইশারা দিয়েছেন একটি কবিতায়। নবীর উম্মত শীর্ষক এ কবিতায় তিনি লিখেছেন, সালাম কর, কিন্তু মনে রেখ তুমি সবুজ পোশাকে রয়েছ। সবুজ পতাকা শীর্ষক কবিতায়ও তিনি এ বিষয়ে আভাস দিয়েছেন।
মুসলমানদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বা ফরজ ইবাদাত হিসেবে নামাজ পড়ার বিষয়টিও বুনিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বিষয়ে যে মুসলমানদের কাছে আল্লাহর নির্দেশ মহানবীর (সা) মাধ্যমে দেয়া হয়েছে তা তিনি জানতেন। নামাজিদের পবিত্রতা ও সারল্য বুনিনকে মুগ্ধ করেছে। তিনি এ প্রসঙ্গে এক কবিতায় লিখেছেন:
সূর্য ডুবে যাচ্ছে/ রং লেগেছে তাতে আগুনের শিখার/ ধুসর ও নীলাভ সবুজ মরুর মাঝে
ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে/ এবং ঢলে পড়ছে ঘুমের দেশে
আর নত হচ্ছে কুরবানির মাথাগুলো/সময় হয়েছে তার/ সূর্যকে বিদায় দেয়ার
জুতাগুলো খুলে /আমরা নামাজে দাঁড়াব /দয়ার্দ্র উদার আকাশের নীচে/ অসংখ্য তারকার সঙ্গে/ নীলাভ ধুসর ও কালো ছায়ায়
... আর দোয়ার মধ্য দিয়ে মাটিতে নোয়াব শির /ঠিক যেমন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পরে তীরে
রুশ কবি ইভান বুনিনের বিভিন্ন লেখা থেকে বোঝা যায় তিনি মানুষের পরিণতি ও বিশ্বাস নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর এ জন্যই তিনি নানা ধর্মের মানুষকে বলতেন ঐক্যবদ্ধ হতে এবং ধর্ম ও নৈতিকতার বিধানগুলো রক্ষার আহ্বান জানাতেন। তিনি স্বদেশ থেকে দূরে থাকলেও ধর্ম ও মানবীয় পূর্ণতার দিকগুলো এড়িয়ে চলতেন না, বরং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেসবের ওপর অবিচল ছিলেন। ।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।