অক্টোবর ১৬, ২০২০ ২০:২০ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা লেবাননি খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ ফিলিপ কে হিট্টির দৃষ্টিতে মহানবীর (সা) জীবন ও অনন্য সাফল্যের নানা দিক সম্পর্কে জেনেছি।

মক্কায় মহানবী (সা) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানদের ওপর কুরাইশ কাফের-মুশরিকদের জুলুম নির্যাতন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় মুসলমানদের কেউ কেউ আবিসিনিয়ায় ও আরও পরে মদিনায় হিজরত করেছেন। মদীনায় মুসলমানদের হিজরতের পথ প্রশস্ত হওয়ার কারণ হল মদিনা তথা ইয়াসরিব শহরের একদল মানুষ মুসলমান হয়েছিল পবিত্র মক্কায় হজের সময় মহানবীর (সা) সরাসরি দাওয়াত পেয়ে। এই নওমুসলিমদের দাওয়াতের সুবাদে মদিনায় আরও অনেকে মুসলমান হন। এভাবে মদিনায় মুসলমানদের এক শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে ওঠে।

মদিনায় আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা দীর্ঘ বহু বছর ধরে এ দুই গোত্রের যুদ্ধে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। মক্কায় একজন নবীর তথা শেষ নবীর আবির্ভাবের খবর শুনে তারা শান্তির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। তারা ইহুদিদের কাছে শুনেছিল যে শেষ নবী (সা) মক্কায় আবির্ভূত হবেন। তাই তারা মহানবীর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দাওয়াত পেয়ে খুব দ্রুত মুসলমান হতে থাকে। ইসলামের এ ধরনের অগ্রগতির খবর শুনে ও বিশেষ করে সুসংঘবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে মুসলমানরা দলে দলে মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাচ্ছে দেখে মক্কার কাফের মুশরিকরা বিচলিত হয়ে পড়ে এবং তারা ইসলামকে ধ্বংসের লক্ষ্যে শয়তানের পরামর্শ অনুযায়ী কুরাইশদের প্রত্যেক গোত্র হতে এক একজনকে নিয়ে মহানবীকে (সা) হত্যার অভিযানে অংশ নেয়ার ষড়যন্ত্র করে যাতে বনি-হাশেম গোত্র এর মোকাবেলার সাহস না রাখে! কিন্তু মহান আল্লাহ এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি মহানবীকে (সা) জানিয়ে দিলে তিনি নিজ বিছানায় হযরত আলীকে শুইয়ে দিয়ে মদিনার দিকে হিজরত করেন।

মহানবী (সা) মদিনায় আসছেন শুনে মদিনার জনগণের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  ইয়াসরিব শহরের নাম বদলে তা হয় মদিনাতুননাবী বা নবীর শহর। মদিনায় পৌঁছে বিশ্বনবী (সা) সেখানকার ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গে শান্তি বা ঐক্যের চুক্তি করেন। আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যেও ঐক্য সৃষ্টি করেন এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে গড়ে তোলেন কিংবদন্তীতুল্য ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। শান্তি, সুন্দর আচার-আচরণ, সুধর্ম ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সব জাতি ও ধর্মের অধিকার রক্ষা-কেন্দ্রীক মদিনা সনদের ভিত্তিতে সেখানে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র। মহানবী (সা) যে ঐক্যের কত বড় রূপকার ও কত বড় মাপের রাষ্ট্র-নায়ক ছিলেন তা মদীনা-সনদসহ তাঁর মাধ্যমে গড়ে-তোলা নানা চুক্তির ধারাগুলো থেকেও স্পষ্ট। একটি উন্নত রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে তুলে তিনি একত্ববাদের মিশনসহ আসমানী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের পথ আরও সহজ করে তোলেন। মদিনার জনগণ যেভাবে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামকে চিরতরে সুসংহত ও বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেয় তাও মহানবীর শ্রেষ্ঠ সাফল্যের অংশ হিসেবে গবেষকদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়।

পি কে হিট্টি লিখেছেন: ‘পরবর্তী যুগগুলোর জন্য মদিনার সমাজ ছিল একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের ক্ষুদ্র চিত্র। কেবলই হতাশাজনক যুদ্ধ, অনৈক্য ও ঝগড়া-বিবাদে অভ্যস্ত আরব জাতি ও গোত্রগুলোকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করে মহানবী (সা) আরব ভূখণ্ডে এমন এক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন যে তা বিশ্বের এক বিশাল অঞ্চল থেকে ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মকে বিতাড়িত করে তার জায়গা দখল করে এবং এখনও বিশ্বের মানবজাতির এক বিশাল অংশ তাঁরই অনুসারী! অথচ আরব দেশ বলতে কোনো সুসংঘবদ্ধ বা সুসংগঠিত দেশই ছিল না, বরং তা ছিল একটি ভৌগলিক নাম মাত্র! এভাবে মুহাম্মাদ (সা) এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে মজবুত করে গড়ে তোলেন যে খুব শিগগিরই সে যুগের সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও উন্নত অঞ্চলগুলো ওই সাম্রাজ্যের পরিসরের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল। মুহাম্মাদ (সা) (মহান আল্লাহ ছাড়া) কারো কাছ থেকেই কোনো বিদ্যা শেখেননি। অথচ এমন এক বই তার ওপর নাজেল হয়েছে যে বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ জনগণ আজও ওই বইটিকে সব ধরনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ধর্মীয় জ্ঞানের পরিপূর্ণ এবং পূর্ণাঙ্গ ভাণ্ডার বলে মনে করেন।

প্রাচ্যবিদদের অনেকেই খুবই ভ্রান্ত ধারণা ও তথ্যের প্রভাবে মনে করেন যে মহানবী তথা রাসুলে পাক (সা) পারিপার্শ্বিক নানা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কুরআন রচনা করেছেন কিংবা কুরআনে ও এর কাহিনীগুলোতে রয়েছে তাওরাত ও ইঞ্জিলের প্রভাব ও অনুকরণ! একইভাবে ভ্রান্ত ধারণার আলোকে কোনো কোনো প্রাচ্যবিদ কুরআনে বর্ণিত কাহিনীগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ তুলে ধরেন এবং এসব কাহিনীকে কল্প-কাহিনী বা রূপকথা বলে মনে করেন!  কিন্তু পি কে হিট্টি বিকৃত হয়ে পড়া ইঞ্জিল ও তাওরাতের কাহিনীগুলোর সঙ্গে কুরআনে বর্ণিত কাহিনীর তুলনা করে মনে করেন যে কুরআনের এসব কাহিনী পুরোপুরি বাস্তব ও সত্য-ইতিহাস। তাঁর মতে কুরআন এভাবে অতীতের ধর্মগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতিগুলোর ভালো ও মন্দ কাজের পাতাগুলো তুলে ধরে যাতে পরবর্তী জাতিগুলো এইসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং অতীতের ব্যর্থতাগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয় ও অনুশোচনামূলক পরিণতির শিকার হতে না হয়। হিট্টি লিখেছেন, কুরআনের কাহিনীগুলো মানুষকে পরিশুদ্ধ ও  মার্জিত বা উন্নত করতেই এ মহাগ্রন্থে স্থান পেয়েছে, কেবল গল্প বর্ণনাই এসবের উদ্দেশ্য নয়, বরং শিক্ষা নেয়ার সুযোগ দেয়াই এসবের উদ্দেশ্য যাতে মানুষ জানতে পারে যে মহান আল্লাহ অতীত যুগে সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কার ও অসৎ লোকদের শাস্তি দিয়েছিলেন।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।