প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান (চার)
গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি দশম ও একাদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
মোল্লা সাদরা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান দার্শনিক। তাঁর খ্যাতি কেবল ইরান ও মুসলিম বিশ্বেই সীমিত থাকেনি। পাশ্চাত্যেও ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর কীর্তি। পাশ্চাত্য ইসলামী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে খ্রিস্টিয় ১১ শতকের দিক থেকে। ইবনে রোশ্দ্, ইবনে সিনা ও গাজ্জালির লেখনী থেকেই তাদের এই পরিচিতি শুরু হয়। পাশ্চাত্যের মনোযোগ বেশ কিছুকাল মূলতঃ ইবনে সিনার ওপরই নিবদ্ধ ছিল। গবেষকদের মতে অগাস্টিনের সূচিত দার্শনিক ধারার বেশিরভাগ অনুসারীই ছিলেন ইসলামী দর্শনের অনুসারী। এই বিশেষ যুগে ইসলামী দর্শন পশ্চিমা চিন্তাধারা ও দর্শনের ওপর গভীর প্রভাব রেখেছিল।
আসলে পশ্চিমা জগৎ গ্রীক সভ্যতার চিন্তাধারা ও দর্শনের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছিল। ইসলামী দর্শনের হাত ধরে তারা আবারও এই যোগসূত্র ফিরে পায়। মুসলিম দার্শনিকরা কেবল গ্রিসের দর্শন তুলে ধরেছিলেন তা নয় তারা দর্শনে অনেক নতুন ধারা ও মতামতও যুক্ত করেছেন। ইবনে সিনা, ইবনে রোশ্দ্ ও গাজ্জালির মত মুসলিম দার্শনিকদের সুবাদে ইউরোপে দর্শনের নতুন ধারা গড়ে ওঠে।
মোল্লা সাদরা দর্শন বিষয়ে যখন তার লেখালেখি উপহার দিচ্ছিলেন তখন পাশ্চাত্যে জেগে উঠেছিল দেকার্তের পক্ষ থেকে আধুনিক দর্শনের ধারা। এ যুগে পাশ্চাত্যের দর্শন প্রাচ্যের দর্শন থেকে নিজেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখেছে। প্রাচ্যের দর্শনকে ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে তারা ভেবেছে যে প্রাচ্যের ও ইসলামী দর্শনের মুখাপেক্ষী নয় তারা। আর এই হামবড়া-মদমত্ত ভাবের জন্যই তিন শতক ধরে মোল্লা সাদরার দর্শনের দিকে আকৃষ্ট হয়নি পশ্চিমা দর্শন ও দার্শনিকরা। অবশেষে আধুনিক যুগের চিন্তাগত ও আধ্যাত্মিক সংকটের শিকার হয়ে পাশ্চাত্য আবারও প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও চিন্তাজগতের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। দুনিয়াতে স্বর্গ বা আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের গ্লানি নিয়ে পাশ্চাত্য আবারও পূর্ব দিকে দৃষ্টি দিতে থাকে। পূর্বমুখী এই ধারার অগ্রপথিক হলেন ঐতিহ্য-প্রেমী ফরাসি দার্শনিক রেঁনে গেনোন ও হেনরি কোরবিন।

বিংশ ও একবিংশ শতকে পাশ্চাত্যে যারা মোল্লা সাদরার দর্শন তুলে ধরেছেন তাদের তিন প্রজন্মের প্রথম প্রজন্মে রয়েছেন হেনরি কোরবিন, ফজলুর রহমান মালিক, সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর্ , মাহদি হায়েরি, মাহদি মোহাক্কিক, তুশিহিকু ইজুৎসু ও জাওয়াদ ফালাতুরি। নাম দেখেই বোঝা যায় এই গ্রুপের কেবল হেনরি কোরবিন ছাড়া অন্য সবাই পাশ্চাত্যে এসেছেন প্রাচ্য থেকে। নানা প্রবন্ধ ও বই লিখে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ক্লাসে তারা তুলে ধরেছেন মোল্লা সাদরার দর্শন ও চিন্তাধারা।
পাশ্চাত্যে মোল্লা সাদরার দর্শন ও চিন্তাধারার প্রচারক দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে রয়েছেন এ ধারার প্রথম প্রজন্মের হাতে গড়ে তোলা ছাত্ররা। এদের বেশিরভাগই হয় ইরানি নতুবা ইরানে এসে মোল্লা সাদরার দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভিন্ন দেশের অধিবাসী। ইরানিদের মধ্যে রয়েছেন শ’দ-রাভান হোসাইন জিয়ায়ি। আর ভিনদেশিদের মধ্যে রয়েছেন জন কুপার, উইলিয়াম চিত্তিক, জেমস মোরিস, হারম্যান ল্যান্ডুলাট অলিভার লিম্যান প্রমুখ।
পাশ্চাত্যে মোল্লা সাদরার দর্শন ও চিন্তাধারার প্রচারক তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে রয়েছেন পাশ্চাত্যের সেইসব অধ্যাপক ও ইসলামী দর্শন প্রচারক যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অধ্যাপক নাস্র্ ও ইরানি অধ্যাপকদের কাছে। এদের কয়েকজনের নাম হল: গিলবার্ট ডোরান, পল হার্ডি, জোসেফ লোম্বার্ড, আহমাদ শাহ কাযেমি, বিলাল ক্যাসপিনার, ক্রিশ্চিয়ান বোনো ও মোহাম্মাদ রুস্তাম।
তবে মোল্লা সাদরার দর্শনের এই তিন প্রজন্মের চর্চাকারীদের শীর্ষ-কেন্দ্র বা প্রধান চিন্তাবিদ ছিলেন আল্লামা সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ি। আর ফ্রান্সের দর্শন বিষয়ক চিন্তাধারায় ইসলামী দর্শনকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন হ্যানরি কোরবিন। কোরবিনের ব্যাপক প্রভাব থাকায় ও কোরবিনের কোনো কোনো ছাত্রের সহায়তায় ইসলামী দর্শনের নানা দিক ফরাসি দর্শনের চিন্তাধারায় স্থান করে নিয়েছে।
ইজুৎসু, ফজলুর রহমান ও সাইয়্যেদ হোসাইন নাসরের মত চিন্তাবিদদের সহায়তায় ইসলামী দর্শন ও বিশেষ করে মোল্লা সাদরার দর্শন-চর্চা ইউরোপেও ব্যাপকভাবে প্রচলন হয়েছে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়-মহলে এখন সাদরার দর্শন চর্চা অনেক সুপরিসর। ইসলামী দর্শন ও বিশেষ করে মোল্লা সাদরার দর্শন এখন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, হার্ভার্ড, শিকাগো ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয় ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে। ফ্রান্সেও ক্রিশ্চিয়ান বোনো ও ক্রিশ্চিয়ান জামবেঁর মত বিখ্যাত ব্যক্তিদের তত্ত্ববাধানে মোল্লা সাদরার দর্শনসহ ইসলামী দর্শন চর্চার পথ প্রশস্ত হয়েছে। মোল্লা সাদরার দর্শনকে এখন ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংলাপের মাধ্যম বা এক্ষেত্রে সংযোগ সেতু হিসেবেও বিশেষভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ইসলাম ধর্ম মানে না, কিন্তু দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে এড়াতে পারে না তাদের সঙ্গে মোল্লা সাদরার বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শনের ভিত্তিতে বিতর্ক করা এবং বস্তুবাদী চিন্তাধারার অসারতা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা যায়।
মোল্লা সাদরার দর্শনের মাধ্যমে অস্তিত্ব, আল্লাহর অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা, পরকালীন জীবন, নৈতিকতার গুরুত্ব-এসবই প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করা যায়। কুরআন ও হাদিসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এসব বিষয়কে যে বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় তা প্রমাণ করেছেন মোল্লা সাদরা। এভাবে পরোক্ষভাবে মহান আল্লাহর বাণী ও মহানবীর (সা) আহলে বাইতের চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের শিক্ষিত সমাজের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে।
মোল্লা সাদরার বিষয়ে বহু বই ও প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সাদরার আসফার গ্রন্থটির অষ্টম ও নবম খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদ বই আকারে বের হয়েছে।
'জরাথ্রুস্ত থেকে আজ পর্যন্ত ইরানি ও ইসলামী দর্শনের পরিচিতি' শীর্ষক একটি বই ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। বইটির শীর্ষ দুই সম্পাদক হলেন সাইয়্যেদ হোসাইন নাস্র্ ও মাহদি আমিন রাজাভি। এ বইয়ে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের দর্শন চিন্তা তুলে ধরার সময় তার লেখা বইয়ের কিছু অংশও তুলে ধরা হয়েছে। বইটির চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে সোহরাওয়ার্দির ইশরাক্বি দর্শন এবং পঞ্চম খণ্ডে স্থান পেয়েছে মোল্লা সাদরার দর্শনসহ ইরানের শিরাজ, ইস্ফাহান ও তেহরানের দার্শনিক ঘরানার পরিচিতি। মোল্লা সাদরার দর্শনের পটভূমি ও সাদরার মৃত্যুর পর থেকে কাযার শাসনামল পর্যন্ত দর্শনের এই ধারার অবস্থাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে বইটির পঞ্চম খণ্ডে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।