ইরানের পণ্যসামগ্রী: বিশ্বের বহু দেশে রপ্তানি হয় ইরানি আপেল
গত আসরে আমরা বলেছিলাম ইরানের কৃষিপণ্যের মধ্যে বাগ-বাগিচাপণ্য আপেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সমগ্র বিশ্বেই ইরানের বাগানজাত বিচিত্র ফলফলাদি গুণ ও মানের দিক থেকে বেশ সমাদৃতি পেয়েছে। গত আসরে আমরা আপেল নিয়ে কথা বলেছিলাম।
আপেলের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। তাই আপেল একটি বাণিজ্যিক পণ্য হয়ে উঠেছে সারাবিশ্বে। প্রবীন বয়সে যারা জয়েন্টে ব্যথা এবং গেঁটেবাত সমস্যায় ভোগেন তারা লাল মাংস খাওয়া কমানোর পাশাপাশি নিজেদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় নিয়মিত আপেল অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কাঁচা বা সেদ্ধ আপেল দেহে ইউরিক অ্যাসিড গঠনে বাধা দেয় এবং আপেল খাওয়ার ফলে দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসিড প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। যারা চিন্তাভাবনামূলক মানে গবেষণা কিংবা ব্রেন ওয়ার্ক করেন এবং যাদের কাজে গভীর মনোযোগ প্রয়োজন পড়ে তাদের জন্যও কোনোভাবেই আপেল খাওয়া ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আপেল মস্তিষ্কে ফসফরাসের একটি ভাল উত্স। আপেল খুব শক্তিশালী বিষ পরিষ্কারক একটি ফল। বেহেশতি এই ফলটি প্রশান্তিকর এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। সুতরাং আপেল বেশি বেশি খাওয়া উচিত।
আপেল বাগানে উৎপাদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। ইরানে আপেল উৎপাদনের ইতিহাস বেশ পুরোণো এবং দীর্ঘদিনের। ইরানের আবহাওয়া আপেল উৎপাদন এবং তার উন্নয়নের জন্য বেশ উপযোগী। এ কারণে ইরানের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণের বেশিরভাগ এলাকাতেই আপেল বাগানের চাষ করা হয়। এই বাগান চাষ সম্পর্কিত বিচিত্র তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী ইরানের বাগানে সেই প্রাচীনকাল থেকে যেসব আপেল গাছ লাগানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য ব্যাপক। সামগ্রিকভাবে ইরানে যেসব ঋতুতে আপেল খাবার উপযোগী হয় সেদিক বিবেচনায় আপেলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

এক ভাগে পড়বে গ্রীষ্মকালীন আপেল যার মধ্যে রয়েছে ফার্সি ভাষায়-গোলাব, মারগেহ, অলমসি, শাফিঅবদি,গরফুজঅলমা এবং কান্দাক জাতীয় আপেল। আর দ্বিতীয় ভাগে পড়বে শরত এবং শীতকালীন আপেল। এই ভাগে পড়বে ফার্সি ভাষায়-আব্বাসি মাশহাদ, গোলশাহী, উগজ শিরভন, রুয়িন, জানুয, দারিয়ন, শেমিরনি, সোলতনি এবং খালখল জাতীয় আপেল। এইসব ইরানি আপেলের বাইরেও বিদেশি জাতের কিছু আপেলও উৎপাদিত হয় ইরানে যেগুলোর জন্য ইরানের আবহাওয়া উপযোগী। ২০১৪ সালে বিশ্বে উৎপাদিত আপেলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইরানের অবস্থান চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে। ওই বছর ইরানে উৎপন্ন আপেলের পরিমাণ সমগ্র বিশ্বে উৎপাদিত আপেলের পরিমাণের তুলনায় শতকরা চার ভাগেরও বেশি ছিল।
ইরানে আপেল উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে কথা হচ্ছিল। সরকার আপেল উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা ও নীতির ব্যাপারে বেশ আন্তরিক। এ নিয়ে প্রায় তিন দশক ধরে ব্যাপক গবেষণার ফলে ইরানে এখন আপেল উৎপাদনের পরিমাণ তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ইরানব্যাপী এখন আপেল উৎপাদনের জন্য তিন লাখ হেক্টরের বেশি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। হেক্টর প্রতি সতের টনের মতো আপেল উৎপাদিত হয়। অবশ্য যারা বিশেষজ্ঞ উদ্যান পরিচর্যাকারী তারা হেক্টর প্রতি এক শ ত্রিশ টন পর্যন্ত উৎপাদন করেছেন বলে রেকর্ড রয়েছে।
ইরানের যেসব প্রদেশে আপেল উৎপাদিত হয় সেসব প্রদেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: পূর্ব ও পশ্চিম আজারবাইজান, তেহরান, ফার্স, ইস্ফাহান, খোরাসানে রাজাভি, হামেদান, চহর মাহলে বাখতিয়রিসহ আরও অনেক প্রদেশ।পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশেই আপেল বাগানের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই প্রদেশে বছরে মোটামুটি দশ লাখ টন আপেল উৎপাদিত হয়।ইরানে উৎপাদিত মোট আপেলের শতকরা আটত্রিশ ভাগই উৎপাদিত হয় পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশ এবং এই প্রদেশের উরুমিয়ে শহরে।উরুমিয়ে এলাকাটি আবহাওয়া পার্বত্য এবং আপেলসহ আরও বহু ফল চাষের উপযোগী।

ইরানের অন্য যে এলাকায় গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত আপেল উৎপাদিত হয় তা হলো ইস্ফাহান প্রদেশের সামিরোম। এই প্রদেশে রয়েছে ষাট হাজার হেক্টর আপেল বাগান। বছরে এখানে প্রায় দশ লাখ টন আপেল উৎপাদিত হয়। সামিরোম এলাকাটি ইস্ফাহানের মধ্যে আপেল উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এলাকা। এর কারণ হলো এখানকার উপযোগী আবহাওয়া। ইরানের লাল আপেলের জন্য বিখ্যাত হলো তেহরানের নিকটবর্তী দামাভান্দের আপেল। বহু বছর ধরে উন্নতমানের এই লাল আপেল উৎপাদিত হচ্ছে ইরানে। গবেষণায় দেখা গেছে অন্যান্য আপেলের তুলনায় এই লাল আপেলের পুষ্টিগুণ কয়েক গুণ বেশি।তেহরানে উৎপাদিত আরেক প্রকারের আপেল হলো গোলাবে শাফিঅবদি। এই আপেলটি দেখতে নাশপাতির মতো অনেকটা। ঘ্রাণও একটু ভিন্ন রকমের।তবে এই জাতের আপেল খুব বেশি সময় থাকে না। এর চাহিদাও বেশি।

সেমনান প্রদেশের শাহরুদেও এক ধরনের আপেল উৎপাদিত হয় নাশপাতি টাইপের।আকারে একটু ছোট তবে ভেতরে লাল। এই আপেল খুব কম উৎপাদিত হয়। ওই এলাকার লোকজনই হালকা টক স্বাদের ওই আপেল ব্যবহার করে। উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে সেমনানের বাইরে এই আপেল পাঠানোর সুযোগ হয় না। উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে তাজা তাজা ফল এখন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শুকিয়ে খাওয়া যায়, বিচিত্র মিষ্টি জাতীয় পণ্য তৈরি করে খাওয়া যায়, মোরব্বা বানিয়ে খাওয়া যায় এমনকি বিভিন্ন খাবারেও ফল ব্যবহার করা যায়। ইরানের ফলফলাদি এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি করা হয়। জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, পাকিস্তান, ইরাক, কুয়েত, ওমান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, রাশিয়া, কিরঘিজস্তান, মালয়েশিয়া, ভারতসহ আরও বহু দেশে যায় ইরান ফলফলাদি। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।