ডিসেম্বর ১৫, ২০২০ ২০:১০ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের বিখ্যাত আরেফ, ইতিহাসবিদ এবং মরমি কবি আবদুর রহমান জামি’র রচনা ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

গত বেশ কয়েকটি পর্বে আমরা ইরানের প্রখ্যাত মনীষী, সুফি-সাধক ও ইতিহাসবিদ আবদুর রহমান জামি’র জীবন  ও রচনা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা তার রচনা ও চিন্তাধারার নানা দিক সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরব। 

মোল্লা জামির লেখা বিখ্যাত সুফিদের জীবনী সংক্রান্ত বই ‘নাফাহাতুল উনস্‌’ সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে বইটির পুরো নাম ‘নাফাহাতুল উনস্‌ মিন হাযারাতিল কুদস’ তথা পবিত্র ব্যক্তিদের প্রেমময় নিঃশ্বাস বা স্নেহের পরশ। এ বইটি খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের ফার্সি গদ্য সাহিত্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। নানা বইকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করে লেখার কারণে এ বইয়ের ভাষা কখনও বেশ সাবলীল, সরস ও কাব্যময় এবং কখনও কিছুটা জটিল ও নীরস। তিনি অতীতের বইগুলোতে ব্যবহৃত নানা জটিল শব্দ ও পরিভাষাকে যথাসম্ভব সহজভাবে ও সাধারণ জনগণের বোধগম্য ভাষায় নিজের এ বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বর্ণনার মূল রূপ তুলে ধরার জন্য সব পরিভাষা ও বাগধারাকে জামি সহজভাবে তুলে ধরেননি।

ফার্সি ভাষার পুরনো শব্দ-ভাণ্ডার, বাগধারা ও পরিভাষা সম্পর্কে গবেষণায় আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য এ বইয়ের রয়েছে অপরিসীম মূল্য। এইসব শব্দ ও পরিভাষার কোনো কোনোটি জামির নিজেরই উদ্ভাবন বা নিজস্ব সৃষ্টি। জামি তার এ বইয়ে অনেক আরবি শব্দও ব্যবহার করেছেন সুফিদের পরিভাষা, কুরআনের আয়াত, হাদিস ও কবিতার অংশ তুলে ধরতে গিয়ে।

‘নাফাহাতুল উনস্‌’ শীর্ষক বইয়ে জামি প্রয়োজনমত অনেক পুরনো ফার্সি শব্দও ব্যবহার করেছেন এবং একই শব্দের নানা অর্থে ব্যবহারও দেখা গেছে এ বইয়ে। শব্দ-সচেতন জামি এ বইয়ে পাঁচ ডজন ফার্সি প্রবাদ বাক্যও ব্যবহার করেছেন। এসব প্রবাদ বাক্যের অনেকগুলো সুফিদের জীবনী সংক্রান্ত অতীতের বইগুলোতে ছিল না। ‘নাফাহাতুল উনস্‌’ শীর্ষক বইটিতে বিভিন্ন পেশার ব্যাপক উল্লেখ ও নানা ঘটনার বর্ণনা দেখা যায়। ফলে তা হিজরি নবম শতকের ইতিহাস, সমাজ ও জন-জীবন সম্পর্কে জানারও এক অমূল্য মাধ্যম। এ বইয়ে বর্ণিত অনেক পেশা ও পেশার নাম আজকাল আর নেই বা থাকলেও তা ভিন্ন নামে পরিচিত। হিজরি নবম শতকের ইরানি জনগণের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানারও এক বড় মাধ্যম হল এ বই। এসব সংস্কৃতির অনেক কিছুই আবার সুফিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।

মাওলানা জামি একজন শক্তিশালী কবি। তিনি অতীতের কবিদের অনেক কলা-কৌশল খুব ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন এবং সেইসব কৌশলকে তার কবিতায় সৃষ্টিশীল রূপ দিয়ে ব্যবহার করেছেন। জামির লাইলি ও মজনু কাব্যটিতে রয়েছে  নিজামি ও আমির-খসরুর একই নামের কাব্যটির প্রভাব। তার হাফত আওরঙ্গ বা সাত সিংহাসন শীর্ষক কাব্য-সংকলনটি কবি নিজামির প্রভাব রয়েছে বলে জামি নিজেই উল্লেখ করেছেন।  তার সিলসিলাতুল যাহাব কাব্যে দেখা যায় কবি সানায়ির উদ্যান কাব্যের এবং কবি আওহাদির জমে জাম কাব্যের  গঠন-রীতির প্রভাব। জামির সালামান ও আবসাল নামক কাব্যটি ইবনে সিনার ইশারাত নামক বইটির দ্বিতীয় ব্যাখ্যা সম্পর্কিত নাসিরউদ্দিন তুসির বইয়ের বক্তব্যের কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপ। জামির সোবহাতুল  আবরার বা ধার্মিকের পুরস্কার শীর্ষক বইটি সম্পূর্ণ অভিনব ছন্দরীতিতে লেখা।

জামি তার কবিতা ও কাব্যগুলো লিখেছেন ধর্ম বা কুরআন হাদিসের শিক্ষা, নৈতিকতা, সুফিতত্ত্ব, খোদাপ্রেম ও আত্মগঠনমূলক বিষয় তুলে ধরার জন্য। কাব্যের মধ্যে নানা কাহিনী ব্যবহার করে তিনি এক্ষেত্রে অনন্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। জামি ইরফান বা সুফিবাদের নামে নিরেট বৈরাগ্যবাদ বা ঘরকুনো হওয়াকে সমর্থন করতেন না। জামির ইরফান বা আধ্যাত্মিক খোদাপ্রেম তত্ত্ব একত্ববাদ ও ইবাদাতকেন্দ্রীক। তিনি সুফিতাত্ত্বিক ফানাফিল্লাহ বা নিজ সত্ত্বাকে আল্লাহর প্রেমে আত্মহারা করে দেয়া এবং ওয়াহদাতে ওজুদ বা অস্তিত্বের একত্বের তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনের আয়নায় খোদাপ্রেমের নুরের প্রতিফলন দেখার যোগ্যতা অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার কাব্যিক বক্তব্যে।

খোদাপ্রেম ছাড়া মানুষ প্রকৃত মানুষ ও অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারে না বলে জামি মনে করতেন। জামি তার কাব্য ও কবিতায় কপট ধার্মিক ও কপট সুফিদের ওপর সমালোচনার তীব্র  কষাঘাত হেনেছেন। তার মতে আমলবিহীন আলেম যেন সোনাভর্তি থলের পরিবর্তে খালি থলের অধিকারী। ইবনে আরাবির অনুকরণে জামিও ছিলেন খোদায়ি বিষয়ে নিরেট যুক্তিবাদী দর্শন ও দার্শনিকদের বিরোধী। জামি কেবলই বিনোদনের জন্য কবিতা লেখার বিরোধী ছিলেন এবং কবিদের চাটুকারিতার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। সমাজ-সচেতন জামি তার যুগের লোভী ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষের লোভ ও প্রবৃত্তি পূজারও নিন্দা জানিয়েছেন তার কবিতায়। অন্যদের ঠকাতে অভ্যস্ত এ ধরনের মানুষকে দস্যু বা রাহ্‌জান বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।  জামির যুগে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল না। জামি নারীর সৌন্দর্যের চেয়ে তাদের সতীত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

জামির ৪৫৯টি চিঠি-পত্র ঐতিহাসিক সম্পদ হিসেবে এখনও টিকে রয়েছে। এসব চিঠিপত্র মাকাতেব নামের একটি বই প্রকাশের মাধ্যমে। এসব চিঠির মূল কপি উজবেকিস্তানের বিজ্ঞান একাডেমিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বইটি জামির ৫৭৫ তম জন্মদিনে তাজিকিস্তানের রাজধানী দোশানবেহ থেকে প্রকাশ করা হয়। এ বইয়ের রুশ অনুবাদও রয়েছে ফার্সি ১৩৭৮ বা ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। জনগণের নানা সমস্যা সমাধানের চেষ্টাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়েছে জামির এসব চিঠিতে। বঞ্চিত  জনগণ যে জামিকে তাদের বন্ধু, মুখপাত্র ও তাদের দরদি বা সহায়তাকারী মনে করত তাও এসব চিঠি থেকে স্পষ্ট। এসব চিঠিতে সে যুগের রাজনৈতিক সংঘাত ও কর ব্যবস্থারও চিত্র রয়েছে। জামির এসব চিঠির কোনো কোনোটি লেখা হয়েছে তৈমুরি সুলতান বয়কারো, মন্ত্রী আমির আলীশির নাওয়া ও প্রখ্যাত সুফি ব্যক্তিত্বদের কাছে। খরা-পীড়িত একটি অঞ্চলের জনগণের কর মওকুফ করা, যুদ্ধে না জড়িয়ে শান্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সংঘাতের নিষ্পত্তি করা, কোনো কোনো মেধাবী গবেষক ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য রাজ দরবার থেকে আর্থিক সাহায্য প্রার্থনাও –এসব জামির কোনো কোনো চিঠির বিষয়বস্তু।

দরবারিদের কারো কারো আচরণে বিরক্ত হয়ে আমির আলীশির নাওয়ায়ি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে চাইলে এক  চিঠিতে জামি তাকে সাধারণ জনগণের সেবা দেয়ার লক্ষ্যে মন্ত্রী পদে বহাল থাকার আহ্বান জানান।  জামির এসব চিঠিতে সে যুগের সাধারণ জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। অথচ বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই তাদের বইয়ে যুদ্ধ-বিবাদ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজা-বাদশাহদের জীবনী তুলে ধরেছেন। তারা এসবের বাইরে জনগণ-সংশ্লিষ্ট এসব দিকে খুব কমই লক্ষ্য করেছেন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ