ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ ০২:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা খ্রিস্টিয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের তথা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক আওহাদউদ্দিন কেরমানির জীবন, রচনা ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলব।

খ্রিস্টিয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের  তথা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের  বিখ্যাত  ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক আওহাদউদ্দিন কেরমানি রুবাইয়াত বা চতুর্পদী কবিতার কবি হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।  তার একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম মাসনাভিয়ে মিসবাহুল আরওয়াহ। নানা কল্পিত শহরের মধ্য দিয়ে তীর্থযাত্রা বা ধর্মীয় সফর হচ্ছে এ কাব্যের বিষয়বস্তু। ইতালিয় মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডি কাব্যের সঙ্গে এর এক ধরনের মিল রয়েছে বলে কেউ কেউ অনুমান করেন।

আওহাদউদ্দিন কেরমানি প্রতিভাবান ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের দায়িত্ব লাভের পর সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি রুকন্‌উদ্দিন সাজ্জাসির খানকায় তার মুরিদ হয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় মশগুল হন। কেরমানি এখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসেবে খেরকা বা খেলাফত লাভ করেন।

আধ্যাত্মিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারো অন্ধ অনুসরণ করাকে কেরমানি সমীচিন মনে করতেন না। সৌভাগ্যক্রমে রুকন্‌উদ্দিন সাজ্জাসির আধ্যাত্মিক সাধনার খানকা ছিল তার জন্য এ দিক থেকে উপযুক্ত স্থান। সে যুগে এ জাতীয় খানকার অস্তিত্ব ও আধ্যাত্মিক সাধনার চর্চা ছিল অনেক বেশি প্রচলিত। প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার সঙ্গে এর পার্থক্য হল প্রচলিত শিক্ষালয়গুলোতে পুঁথিগত বিদ্যার সূত্রগুলো শিখে ছাত্ররা সৃষ্টিশীল নতুন কিছু আয়ত্ত্ব করতে পারত না, কিন্তু এ ধরনের খানকায় খোদার প্রেম-সন্ধানী ছাত্ররা নিজ নিজ প্রতিভা অনুযায়ী নতুন পথ ও ভাবনার অধিকারী হত এবং নিজের ভেতরের ও বাইরের জগতকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পর্যবেক্ষণ করত। ফলে অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে ছাত্ররা এখানে নিজস্ব অভিজ্ঞতা অর্জনের ও সৃষ্টিশীল গবেষণার সুযোগ পেত।

অধ্যাপক ফুরুজানফার মনে করেন এ ধরনের পরিবেশের কারণেই সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত অতীতের খানক্বাগুলোতে খোদাপ্রেমের পথিক ছাত্রদের সঙ্গে তাদের পথপ্রদর্শক পীর বা মুর্শিদদের নানা বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা যেত।  রুকুনউদ্দিন সাজ্জাসিও তার ছাত্রদের এভাবেই প্রশিক্ষণ দিতেন। আর এ জন্যই তার ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল শামসুদ্দিন তাব্রিজি ও আওহাদউদ্দিন কেরমানির মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। এ দু’জনই আধ্যাত্মিক খোদাপ্রেম সাধনায় নতুন পথ ও দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন।

আওহাদউদ্দিন কেরমানির অনুসৃত নীতিমালার অন্যতম নীতি ছিল সৌন্দর্যের আরাধনা। সুফিবাদে এ বিষয়টির রয়েছে খুব গভীর শেকড়। হিজরি তৃতীয় শতকে আবু হালমান দামেশকিও এই পথের অগ্রপথিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

এই ধারার সুফিরা মনে করতেন সৌন্দর্যের আরাধনার মাধ্যমে অনুভূতিকে কোমল ও চরিত্রকে মার্জিত করা যায়। সঙ্গীত ও সামা এ কাজটিই করে বলে কোনো কোনো সুফি ব্যক্তিত্ব মনে করেন।

সুফিদের মতে সঙ্গীত ও সামা মানুষের মনকে পবিত্র ও উজ্জ্বল করতে পারে। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষ খোদাকে পেতে পারে এবং জানতে পারে অদৃশের জগত ও অস্তিত্বের বাস্তবতাকে। আওহাদি বা আওহাদউদ্দিন কেরমানিও এই ধারার অনুরাগী ছিলেন বলে কেউ কেউ তাকে কাফের বলেছে, তাকে তিরস্কার করেছে ও উপহাস করেছে এবং যন্ত্রণা দিয়েছে।  

সৌন্দর্যের আরাধনা-ধারার অনুরাগী সুফিদের সম্পর্কে অভিযোগ করা হয় যে তারা আল্লাহকে পাবার জন্য যে কোনো কাজ ও এমনকি পাপ করাকেও বৈধ মনে করেন! কিন্তু আওহাদউদ্দিন কেরমানির জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে এই অভিযোগকে অপবাদ ছাড়া আর অন্য কিছুই বলা যায় না। 

আওহাদউদ্দিন কেরমানির দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের আরাধনা ও আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।  তিনি এ নিয়ে কয়েকটি চতুর্পদী কবিতা বা রুবাইয়াতও লিখেছেন।

আওহাদি মনে করতেন মানুষ আকৃতি বা কল্পনার জগতে বসবাস করে। উচ্চতর বাস্তবতা ও অর্থ বা ভাব তুলে ধরার জন্য উপমা বা  কল্পনার চেয়ে বড় কোনো মাধ্যম নেই বলে তিনি মনে করতেন। তাই এই কল্পনার মধ্য দিয়েই পথ বের করতে হবে খোদাপ্রেমের পথিককে এবং এসবের উর্ধ্বে উঠে আবিষ্কার করতে হবে মূল বাস্তবতাকে ও উপলব্ধি করতে হবে খোদাপ্রেমকে। যেন আকারের মধ্যেই নিরাকারকে বা সীমার মাঝেই অসীমকে ও বিন্দুর মাঝেই খুঁজে পেতে হবে সিন্ধুকে!

অধ্যাপক ফুরুজানফারের মতে আওহাদউদ্দিন কেরমানি আন্তরিকভাবেই খোদাপ্রেমের সন্ধানী ছিলেন। আধ্যাত্মিক নৃত্য ও সামা সঙ্গীতের আসরে অনেক পীর মুর্শিদ তার সঙ্গে অংশ নিতেন। তারা সামাকে ইবাদত মনে করতেন।

আওহাদউদ্দিন কেরমানি মনে করতেন আল্লাহর প্রকাশ রয়েছে গোটা বিশ্ব-জগতে। বাহ্যিক সৌন্দর্যগুলো আসলে আল্লাহরই সৌন্দর্যের পরোক্ষ প্রকাশ। মানুষের হৃদয় ও আত্মা খোদার ঘর।

ইরান বিষয়ের চেক বিশেষজ্ঞ ইয়ান রাইপকার মতে আওহাদউদ্দিন কেরমানির মত সুফিরা আসমানি সৌন্দর্যের প্রশংসাকে ধুলির ধরার সৌন্দর্য কীর্তণের মধ্যেই দেখে থাকেন। অনেক গবেষক মনে করেন এ ধরনের চিন্তাধারা এক ধরনের মানবতাবাদ যা ইসলামী ইরফানি সাহিত্যের এক বিশেষ যুগের ধারা এবং এই ধারাই পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গিয়ে ‘পূর্ণ মানবের তত্ত্ব’ তুলে ধরেছে।  কারণ সৌন্দর্য নিজেই পূর্ণতা।  সৌন্দর্যের এ ধারার প্রশংসা নতুন কিছু নয়। এ ধারা কেবল আওহাদউদ্দিন কেরমানির মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে। এ ধারার সুফিরা মনে করেন মহান আল্লাহর দাস খোদাপ্রেমের মাধ্যমে এমন পর্যায়ে পৌঁছেন যে মহান আল্লাহ নিজেই তার চোখ, কান, অন্তর ও জিহ্বা হয়ে যান। তাই তারা সব সৌন্দর্যে কেবল আল্লাহকেই দেখেন। আর বাহ্যিক সৌন্দর্যগুলো আল্লাহকে চেনার প্রাথমিক পর্যায় মাত্র এবং খোদাপ্রেমিককে এর চেয়েও গভীরে গিয়ে মহান আল্লাহর সৌন্দর্যকে খুঁজতে হবে। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ