জানুয়ারি ১১, ২০২১ ১৮:০৮ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ২৯ ও ৩২ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلًا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (29)

“আল্লাহ (শিরক ও তৌহিদের জন্য) এক দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন: একটি লোকের উপর পরস্পর বিরোধী কয়েকজন মালিক রয়েছে (এবং প্রত্যেকে তাকে ভিন্ন ভিন্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছে), আরেক ব্যক্তি শুধুমাত্র একজনের অধীন (এবং শুধু তার একার নির্দেশ পালন করে)। এই দুই ব্যক্তির অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।”(৩৯:২৯)

মহান আল্লাহ এই সূরারই ২৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তিনি মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য পবিত্র কুরআনে সব ধরনের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। সেই অলঙ্ঘনীয় বিধানের আওতায় এই আয়াতে মুশরিকদের পাশাপাশি তাদের দুরবস্থার উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, মনে করো একজন ক্রীতদাসের কয়েকজন মালিক রয়েছে যাদের প্রত্যেকে আলাদা আলাদা নির্দেশ দেয়। তাদের একজন যে কাজটি করতে বলে আরেকজন সেই কাজটিই করতে নিষেধ করে। ফলে ক্রীতদাসটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় এবং ভাবে কোন্‌ মালিকের নির্দেশ সে পালন করবে। একজনের নির্দেশ পালন করতে গেলে আরেকজন ক্ষুব্ধ হয় ও তাকে মারধর শুরু করে এবং খাবার ও পারিশ্রমিক বন্ধ করে দেয়।

অন্যদিকে এই আয়াতে আরেকজন ক্রীতদাসের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, যার মালিক মাত্র একজন এবং এই এক ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট রাখাই তার দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই সে তার মালিকের নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কখনো তাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না। মালিকও তার কাজে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাকে খাবার ও পারিশ্রমিকসহ অন্যান্য সব জিনিস প্রয়োজনের চেয়ে বেশিও দিয়ে থাকে।

আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ (আ.) কারাবন্দি থাকা অবস্থায় সহবন্দিদের সামনে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “হে কারাগারের সঙ্গীরা! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ?”

এই আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী, শিরক মানুষকে বিব্রতকর ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। মুশরিক অশান্ত আত্মার অধিকারী হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী মুমিন বান্দার অন্তর প্রশান্ত থাকে। সে এক আল্লাহর গোলামি করে এবং যা চাওয়ার একমাত্র তাঁর কাছেই চায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বোঝারই চেষ্টা করে না। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কিছু উৎসের কাছে হাত পাতে যেসব উৎস তাকে হতাশ করে এবং তার জীবনের শান্তি কেড়ে নেয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মুমিন ব্যক্তি প্রতিটি কাজে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করে। কিন্তু মুশরিক চায় বহু মানুষকে খুশি করতে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে খুশি করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না।

২- শিরক ও তৌহিদের পরিণতি শুধু কিয়ামতের ময়দানে প্রকাশিত হবে না। পার্থিব জীবনেও এর প্রভাব দেখা যায়। মুমিন ব্যক্তি প্রশান্ত আত্মার অধিকারী এবং সব সময় আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী থাকে।  অন্যদিকে অশান্ত আত্মার অধিকারী মুশরিক ‘না জানি কোন্‌ বিপদ আসে’ এই উদ্বেগে সারাক্ষণ তটস্থ থাকে।  

এই সূরার ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:  

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ (30) ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عِنْدَ رَبِّكُمْ تَخْتَصِمُونَ (31)  

“নিশ্চয় আপনার মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে।” (৩৯:৩০)

“অতঃপর কেয়ামতের দিন তোমরা সবাই তোমাদের পালনকর্তার সামনে কথা কাটাকাটি করবে।” (৩৯:৩১)

মুশরিক ও মুমিন দু’জনেরই পার্থিব জীবনের শেষ পরিণতি মৃত্যু। পৃথিবীতে কোনো মানুষই অমরত্ব লাভ করেনি। এমনকি আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা অর্থাৎ নবী-রাসূলগণও এই অলঙ্ঘনীয় বিধানের আওতার বাইরে নন। রাসূলের যেসব শত্রু  তাঁর মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে তাদের জানা উচিত মৃত্যু তাদেরকেও স্পর্শ করবে। সূরা আম্বিয়ার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে: “হে রাসূল! আপনি যদি মারা যান তাহলে তারা কি অমরত্ব লাভ করবে?”

কিন্তু মৃত্যুর অর্থ মানুষের জীবনের সমাপ্তি নয় বরং মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ আখেরাতের চিরকালীন আবাসে প্রবেশ করে মাত্র। আখেরাতের ময়দানে মুমিন ও মুশরিকরা তাদের বিশ্বাসগত ভিত্তি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক শুরু করবে। অর্থাৎ মুশরিকরা সেখানেও তাদের বিশ্বাসের অসারতা স্বীকার করতে চাইবে না বরং নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা সে বিতর্কে হস্তক্ষেপ করবেন এবং সঠিক ও ভ্রান্ত পথ তুলে ধরে তাদেরকে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করবেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সবার জীবনে মৃত্যু অবধারিত এবং এই ঐশী বিধান লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই।

২- কিয়ামতের ময়দানেও মানুষ অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করবে। কিন্তু সেদিনের বিচারক হবেন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ; যিনি দোষী ও নির্দোষকে সঠিকভাবে আলাদা করে দেবেন।

সূরা যুমারের ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ (32)  

“সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে এবং তার কাছে সত্য আগমন করার পর তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তার চেয়ে অধিক যালেম আর কে? জাহান্নাম কাফেরদের বাসস্থান নয় কি?”(৩৯:৩২)

আগের আয়াতে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে সবার উপস্থিত হওয়ার কথা জানিয়ে দেয়ার পর এই আয়াতে সেইসব মানুষের কথা বলা হচ্ছে যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সত্যবাণী গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। যেসব কাফের আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কিংবা যেসব মুশরিক তার ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করে তাদের উভয় দল আল্লাহর সত্য আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করার দায়ে দোষী। কাজেই পার্থিব জীবনে তাদের এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে পরকালে তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। অবশ্য সত্য প্রত্যাখ্যানকারী এসব মানুষের বিপরীতে কিছু মুমিন ব্যক্তিও রয়েছেন যারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা সত্যবাণী মেনে নিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন। সূরা যুমারের পরবর্তী আয়াতের সূত্র ধরে আগামী আসরে আমরা সেসব মুমিন ব্যক্তির কথা তুলে ধরব ইনশা আল্লাহ। 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে জুলুম করার চেয়ে চিন্তাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক জুলুম বেশি গুরুতর। এ ধরনের জুলুমের সবচেয়ে স্পষ্ট উদহরণ হচ্ছে, আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা।

২- বিদ্বেষ, গোঁয়ার্তুমি ও উগ্রতার কারণে মানুষ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং আল্লাহ তায়ালার বক্তব্যের সত্যাসত্য যাচাই করা ছাড়াই তা প্রত্যাখ্যান করে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।