ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২১ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় বলেছিলাম ইরানের ইসলামী বিপ্লব বর্তমান শতাব্দীতে ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রবল উত্থানকে বিশ্বের চিন্তাশীল ও মুক্তিকামী জাতির কাছে অনেকাংশে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

ইরানের মহান এ বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনী (র) হচ্ছেন রূপকথার এমন এক ব্যক্তিত্বের মত যিনি এক কথিত ঘাতক-সরাইখানার ঘাতক হওয়ার আসল রহস্য উদঘাটন করেছিলেন অনন্য সাহসিকতা ও বীরত্ব দেখিয়ে! রাতে ওই সরাইখানায় যে-ই আশ্রয় নিত সে-ই মারা যেত-এমন এক গুজবের কারণে ভয়ে কোনো যাত্রী ওই সরাইখানায় রাত্রি যাপনের সাহস করত না এবং কেউ গেলেও ওই আতঙ্কের কারণেই মারা যেত। কিন্তু একদিন এক বীর এলেন এর রহস্য উদঘাটন করতে যিনি মৃত্যুকে ভয় করতেন না। ওই বীর এক রাতে সেখানে গেলে নানা দিক থেকে ভয়ানক নানা শব্দ তাকে মৃত্যুর ভয় দেখায়। কিন্তু ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে ওই বীর বললেন, সাহসী হলে সামনে আয়! আমি মরতে প্রস্তুত! তাঁর এ কথা শুনেই থেমে গেল ভীতি-প্রদর্শন ও সরাইখানার সম্পদগুলোও চলে আসে তার পায়ের কাছে! আর এভাবেই ওই সরাইখানার ঘাতক হওয়ার ভিত্তিহীনতা ও  অমূলক ভয় সবার মন থেকে দূর হয়ে যায়। 

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (র)ও কথিত ঘাতক সরাইখানার ভয় ভেঙ্গে দেয়ার মতই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জালিম পরাশক্তিগুলোকে মোকাবেলা করা অসম্ভব ও অসাধ্য-এমন অমূলক ভয় ভেঙ্গে দিয়েছেন। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বেই ইরানের বিপ্লবী জাতি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে এমন একটি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে যে বাহিনীকে মদদ দিচ্ছিল বিশ্বের সব পরাশক্তিসহ ২৬টি দেশের সরকার! পবিত্র প্রতিরক্ষার এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইরানই আগ্রাসী সাদ্দামের দম্ভ চূর্ণ করতে সক্ষম হয়। অথচ ইরাকের সাদ্দাম ইরানের সীমান্তবর্তী খুররম শহর দখল করে সাংবাদিকদের বলেছিল: আগামী সপ্তায় আমি তেহরানে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব!  
পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের পরই মার্কিন সরকারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও অনুগত সরকার-প্রধান সেবাদাস মোহাম্মাদ রেজা শাহও তার বাহ্যিক শক্তির শীর্ষে থাকা অবস্থায় সদম্ভে বলেছিল : 'কেউ আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না! আমার রয়েছে সাত লাখ সেনাসহ সব শ্রমিক ও বেশিরভাগ জনগণের সমর্থন!' কিন্তু অদূরদর্শী শাহ জানতো না যে রাজার জোর কেবল অর্থ ও সমর-শক্তির! কিন্তু একজন আধ্যাত্মিক নেতা মানুষের হৃদয়-রাজ্য জয় করে শিগগিরই তাদের রাষ্ট্রেরও সর্বোচ্চ নেতা হচ্ছেন! 
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য সারা বিশ্বের জন্য এক মহা-বিস্ময়কর ঘটনা। ইসলামের প্রাথমিক যুগের পর তথা সুদীর্ঘ প্রায় ১৪০০ বছর পর ইমাম খোমেনীই সর্বপ্রথম জননায়ক যিনি একটি যথার্থ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তা করেছেন একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে। ইমাম খোমেনীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল  কি করে তিনি তাঁর বিপ্লবকে সফল করলেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, মহান আল্লাহর নির্দেশেই তা সফল হয়েছে, আমার চেষ্টায় নয়। - আসলে তিনি সফল হয়েছেন মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও আনুগত্যের কারণেই। তার বিপ্লব ছিল আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা ও তাঁরই সাহায্যের ফল।  তিনি নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করেননি। তিনি আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলায় মহান আল্লাহও তাঁকে সাহায্য করেছেন। 
ইমাম খোমেনী তার দেশের জনগণের ও বিশ্বের বহু মুসলমানের এ ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে ইসলাম ধর্ম রাজনীতি থেকে পৃথক কোনো ব্যক্তি-কেন্দ্রিক ও সমাজ-বিচ্ছিন্ন ধর্ম নয়। তিনি বলতেন, যারা বলে বা মনে করে যে ইসলাম ও রাজনীতিকে পৃথক করে রাখা উচিত এবং এ দুইই পৃথক বিষয় তারা ইসলাম ও রাজনীতি কোনোটাই বুঝতে পারেনি। ইমামের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে এভাবে ইসলামের প্রকৃত রূপ ও শক্তি তুলে ধরেছে। 
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আদর্শ এটা তুলে ধরেছে যে খোদাদ্রোহী শক্তি যত বড়ই হোক না কেন ইমানি শক্তিতে উজ্জীবিত একটি জাতির প্রতিরোধ ও বিজয়কে তা ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম নয়। তাই দেখা গেছে মার্কিন সরকার ইরানি বিপ্লবী ছাত্রদের হাতে ৪৪৪ দিন ধরে আটক কূটনীতিকের বেশধারী আমেরিকান গোয়েন্দাদেরকে মুক্ত করার জন্য রাতের আঁধারে বিমান অভিযান চালিয়েও প্রাকৃতিক ঝড়ের মুখে বিপর্যস্ত হয়।  

আধুনিক বিশ্বের কেউই কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি যে একজন বড় আলেম ও ইসলামী আইনবিদ একদল যোগ্য ও দক্ষ আলেম গড়ে তুলে সুদীর্ঘ দশ বছর ধরে বিশ্বের সব পরাশক্তির বাধা ও রক্ত-চক্ষু উপেক্ষা করে একটি বিশাল রাষ্ট্রে ইসলামী শাসন চালাবেন এবং তারপরও জনগণের অবিসম্বাদিত নেতা হয়ে থাকবেন মৃত্যুর পরও! ইমাম খোমেনীর এই বিপ্লবকে ইরানের কমিউনিস্টরা হাইজ্যাক করবে ও তারাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করবে এমন ভাবনাও কিছুকাল প্রচার করা হয়েছিল। কারণ, পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের পরিচালকরা মনে করতেন: একদল মোল্লা আধুনিক রাষ্ট্র-পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও সংবিধান-এসব বিষয়ে আর কতটাইবা জ্ঞান রাখেন! কিন্তু শহীদ বেহেশতির মত একজন বড় বিচারপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ,  শহীদ আয়াতুল্লাহ মুতাহ্‌হারির মত শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও অধ্যাপক, আয়াতুল্লাহ মেজবাহ ইয়াজদির মত বিচক্ষণ গবেষক এবং শহীদ রাজায়ি ও বহুনারের মত ত্যাগী ও খোদাভীরু রাষ্ট্র-নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা আলী খামেনেয়ির মত বহুমুখী প্রতিভাধর, ত্যাগী, সাহসী, খোদাভীরু ও সংগ্রামী নেতার গৌরবময় ভূমিকা ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে ও ইসলামী রাষ্ট্রকে সাফল্যের দুর্বার অগ্রযাত্রায় গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়। এসবই অলৌকিক বিস্ময়!#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ