কুরআনের আলো
সূরা আয-যুমার: আয়াত ৪২-৪৫ (পর্ব-১২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ৪২ ও ৪৫ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪২ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَى عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَى إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (42)
“আল্লাহ মানুষের প্রাণ সম্পূর্ণরূপে হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার (প্রাণ হরণ করেন) নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ধরে রাখেন এবং অন্যান্যের (প্রাণ তাদের দেহে) ফেরত পাঠান এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিঃসন্দেহে এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে (আল্লাহর শক্তিমত্তার) নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (৩৯:৪২)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মহান আল্লাহ মৃত্যুর সময় মানুষের জান কবজ করেন এবং জীবিত ব্যক্তিদের প্রাণও ঘুমের সময় নিয়ে নেন। তবে যাদের মৃত্যুর নির্দেশ এসে যায় তাদের প্রাণ ফেরত দেয়া হয় না ফলে তারা মারা যায়। অন্যদিকে এখনো যাদের মৃত্যুর ফয়সালা হয়নি তাদের প্রাণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এই আয়াতে মানুষের দু’টি দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটি তার দেহ অন্যটি রুহ বা প্রাণ। মৃত্যুর সময় মানুষের দেহ ও প্রাণের সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। দেহটি নষ্ট হয়ে গেলেও রুহ আল্লাহ তায়ালার কাছে সংরক্ষিত থাকে এবং কিয়ামতের দিন আবার এই রুহকে দেহের সঙ্গে একাত্ম করে দেয়া হবে।
তবে এই আয়াত অনুযায়ী, মানুষ প্রতিদিনই ঘুমানোর সময় সাময়িক মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করে। ঘুমের সময় দেহ ও রুহের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মনে হয় যেন ঘুমের মধ্যে মানুষ মারা যায় এবং জেগে ওঠার মাধ্যমে সে আবার জীবিত হয়।
ঘুমের মধ্যে মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং অনেক সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। এখান থেকে প্রাণ বা রুহের স্বাধীন সত্ত্বার প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ, দেহ ছাড়াই রুহ পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়।
কাজেই ঘুম হচ্ছে মহান আল্লাহর শক্তিমত্তার অন্যতম নিদর্শন। পৃথিবী থেকে গত হয়ে যাওয়া বহু মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়ার পর আর জেগে ওঠেনি এবং আমাদের জীবনেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- দেহ ও প্রাণ দু’টি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বা। মৃত্যু ও ঘুমের সময় তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর মৃত্যুর পর দেহ ধ্বংস হয়ে গেলেও রুহ আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে।
২- ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর ভাই। ঘুমের সময় মানুষ মৃত্যুর দুর্বল এটি রূপের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
৩- ঘুম ও জাগ্রত হওয়ার ঘটনা প্রতিদিন প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘটে। কিন্তু শুধুমাত্র জ্ঞানী ও চিন্তাশীল মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে ভাবে ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
সূরা যুমারের ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ (43) قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (44)
"(মুশরিকরা) কি আল্লাহর স্থলে (দেব-দেবীকে) সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন, তাদের কোনো মালিকানা না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও (কি তারা তোমাদের সুপারিশকারী হবে)?" (৩৯:৪৩)
“বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমানসমূহ ও যমীনে তারই সাম্রাজ্য। অতঃপর তারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (৩৯:৪৪)
মক্কার মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীদেরকে তাদের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করত। তারা বলত: আল্লাহর কাছে শাফায়াত করার জন্য আমরা মূর্তির পূজা করি। এই ভ্রান্ত ধারনা প্রত্যাখ্যান করে এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে কে বা কারা মধ্যস্থতাকারী হবেন তা নির্ধারণ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। মানুষ তার ইচ্ছেমতো কোনো নিস্প্রাণ দেব-দেবীকে এই দায়িত্ব দিতে পারবে না। যাদের পক্ষে নিজেদের কোনো লাভ বা ক্ষতি করার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই তারা কীভাবে মানুষের শাফায়াতকারী হয়?
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, নবী-রাসূলগণ আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হতে পারতেন। হযরত ইউসুফ (আ.)’র ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআনে পাকে বলা হয়েছে, হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা যখন তাদের দুস্কর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হন তখন তারা আল্লাহর কাছ থেকে তাদের গোনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার জন্য নিজেদের পিতা ও আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুব (আ.)কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআনে শাফায়াতের বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়নি বরং দেব-দেবীর শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
২- আল্লাহ তায়ালা যাকে বা যাদেরকে অনুমতি দেবেন সে বা তারা ছাড়া আর কারো পক্ষে মানুষের জন্য শাফায়াত করা সম্ভব হবে না।
সূরা যুমারের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন:
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ (45)
“যখন একক সত্ত্বা হিসেবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়; আর যখন আল্লাহ ব্যতীত অন্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে।” (৩৯:৪৫)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের সামনে একক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা হিসেবে আল্লাহর নাম তুলে ধরা হলে তারা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি অন্যান্য উপাস্যের নাম বলা হয় তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। মুশরিকদের পাশাপাশি দুর্বল ঈমানের অধিকারি যেসব মানুষ পার্থিব জীবনের বাইরে কোনো কিছু বিশ্বাস করতে রাজি নয় তাদের সামনে মহান আল্লাহ এবং তাঁর জ্ঞান ও শক্তিমত্তা নিয়ে কথা তুললেই তারা অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়। তারা তাদের কোনো কাজে আল্লাহর ওপর ভরসা করে না বরং যাদেরকে চোখে দেখতে পায় তাদের ওপর নির্ভর করে।
তারা বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহর সামনে মাথানত করতে নারাজ। কিন্তু নিজের মতো আর দশজন মানুষকে কুর্নিশ করতে তাদের অসুবিধা হয় না। পার্থিব জীবনে ধন-সম্পদ কিংবা উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী মানুষকে তারা সম্মান করে এবং তাদের নিকটবর্তী হতে পারাকে আনন্দ ও গৌরবের বিষয় বলে মনে করে।
এদের বিপরীতে ঈমানদার মানুষদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হলে তাদের মন আনন্দে ভরে যায় এবং তারা আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সূরা আনফালের ২ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, ঈমানদার মানুষের সামনে আল্লাহর কালাম পাঠ করা হলে তাদের ঈমান বেড়ে যায়।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১- আল্লাহ তায়ালার কথা স্মরণ হলে বা তাঁর কথা শুনলে আমাদের অন্তর খুশি হয় কিনা সেটা দেখে আমরা আমাদের ঈমানের বিষয়টি পরীক্ষা করতে পারি।
২- আমরা যদি আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে পৃথিবীর প্রভাবশালী মানুষের কথাকে গুরুত্ব দেই তাহলে মুখে ঈমানের দাবি করলেও বুঝতে হবে যে, আমাদের অন্তরে শিরক প্রভাব বিস্তার করেছে। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।