ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১ ২০:৩০ Asia/Dhaka

ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটায় ইরান পররাষ্ট্রনীতিসহ সব ক্ষেত্রে স্বাধীন নীতির অনুসারী হতে সক্ষম হয়।

ইমাম খোমেনী র বলতেন, প্রাচ্যও নয় পাশ্চাত্যও নয়-ইসলামই শ্রেষ্ঠ (নো ইস্ট নো ওয়েস্ট ইসলাম ইজ দ্য বেস্ট)। এর আগে ইরানের রাজতান্ত্রিক ও স্বৈর-সরকারের প্রধান শাহ কোনো স্বাধীন ইচ্ছাই পোষণ করতে পারতেন না। প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা বাস্তবে ছিল না, বরং ব্রিটিশ-মার্কিন ও পশ্চিমা সরকারগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে এইসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে হত! একবার শাহের মাতা বা সাবেক রানী শাহকে বললেন, তুমি তো জানো তোমার আশপাশের এরা হচ্ছে বিজাতীয় শক্তিগুলোর অনুচর, কিন্তু তা সত্ত্বেও তুমি ওদের তাড়িয়ে দিচ্ছ না কেন? শাহ অত্যন্ত নিরুপায় ও ক্ষমতাহীন ব্যক্তির মত বললেন, এদেরকে বের করে দিলেও আমার আশপাশে এরা আরও অনেক লোক পাঠাবে! তাই এরাই থাকুক যাতে পশ্চিমা সরকারগুলো ইরানের ব্যাপারে স্বস্তি অনুভব করে!
শাহের কুখ্যাত গোপন পেটোয়া বাহিনী ও গোয়েন্দা সার্ভিস সাভাকের প্রধান ও উপপ্রধান এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সবাই মার্কিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে যদিও শাহের কাছ থেকে একটা আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিত কিন্তু এর আগেই তারা সংশ্লিষ্ট ওইসব বিষয়ে ব্রিটেন ও মার্কিন সরকারের কাছে তথ্য পাচার করত! শাহ নিজেও এইসব বাস্তবতার কথা জানতেন!  
ইরানের ওপর ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃত্বকামিতার প্রভাব ছিল এতই গভীর যে হোসাইন ফারদুস্ত ইরানে নিযুক্ত ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রধান ট্রাটের সঙ্গে তার সাক্ষাতের স্মৃতি তুলে ধরে লিখেছেন, ট্রাট খুব অসন্তোষ প্রকাশ করে আমাকে বলেছিলেন শাহ তথা মোহাম্মাদ রেজা জার্মান রেডিও শোনে এবং তাদের পরিকল্পনাগুলোর আলোকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে অনুসরণ বা পর্যবেক্ষণ করছে! ওই সাক্ষাতের পর আমি বিষয়টি শাহকে জানালে তিনি ভয়ানক এক ধাক্কা খেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ইংরেজরা কি করে জানে যে আমি রেডিও শুনি! ... কালকে অন্য সব কাজের আগেই ট্রাটকে বলবে যে মোহাম্মাদ রেজা সব পরিকল্পনা টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং সে ট্রাটের অনুমোদিত রেডিও ছাড়া অন্য কোনো রেডিওই আর শুনবে না!!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের তথ্য অনুযায়ী ইরানে ১৯৭৬ সালে মার্কিন উপদেষ্টার সংখ্যা বেড়ে ৪৬ হাজার হয়েছিল এবং ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর মাধ্যমে ১৯৮০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৬০ হাজারে বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল মার্কিন সরকারের। 
বর্তমানে ইরানের সরকার বিজতীয় শক্তিগুলোর সেবাদাস নয়, বরং বিশ্ব অঙ্গনের এক অসাধারণ স্বাধীন শক্তি। পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে বিশ্বের ৮টি বড় শক্তির অন্যতম ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান! 

সামরিক ক্ষেত্রেও শাহ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও আসল ক্ষমতা ছিল তার বিদেশী প্রভুদের হাতে! একদিন শাহ খুব দুঃখিত চিত্তে তার মাকে তথা সাবেক রাণীকে বললেন, 
প্রিয় মা! এই সালাতানাতকে যেন মৃত ব্যক্তির গোসল দানকারী কোনো এক ব্যক্তি নিয়ে যায়! আমি শাহ ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে ও আমার অনুমতি ছাড়াই আমাদের জঙ্গি বিমানগুলো ভিয়েতনামে নেয়া হয়েছে!
 মার্কিন সরকার সেই পুরনো যুগ থেকেই ইরানে সেনা মোতায়েন করে রাখত! যখনই দরকার মনে করত তারা ইরানের ঘাঁটি ও সাজ-সরঞ্জামকে নিজের মাল মনে করই ব্যবহার করত! যেমন, তারা ইরান থেকে বিমান ও রণতরীর জ্বালানী ফ্রি ব্যবহার করত!
ইরানের কাছে খুব বর্ধিত দামে সমরাস্ত্র বিক্রি করত মার্কিন সরকার! একবার সাড়ে ছয় মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রতিটি বিমানের দাম বাড়িয়ে ১৮ মিলিয়ন ডলার করা হয়! আরেকবার ৬ টি যুদ্ধ-জাহাজের দাম ২৮০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা সত্ত্বেও শাহ ৬০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে বাধ্য হয়! এভাবেই পেন্টাগন ইরানের তেলের আয় গ্রাস করত! 
ইরানের শাহ সরকারের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলেও কিছু ছিল না! ইরান পরিণত হয়েছিল পরাশক্তিগুলোর পছন্দনীয় ভোক্তায়! মাইকেল লিডেন লিখেছেন, মার্কিন সরকার ইরান থেকে তেল কেনা বাবদ এক ডলার খরচ করলেও তার বিপরীতে ইরানিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী কেনা বাবদ দুই ডলার খরচ করত!
মার্কিন জেনারেল উইলিয়ামসন সামরিক উপদেষ্টা বাহিনী প্রধান হিসেবে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ইরানে ছিলেন। তার মতে এ সময় মার্কিন সরকার ইরানের সঙ্গে ৭০০টি চুক্তি সম্পাদন করেছিল এবং তাতে মার্কিন সরকারের আয় হয়েছিল ৪০০ কোটি ডলার! 
সে সময় ইরানের অর্থনীতি ছিল কেবলই তেল-বিক্রি-নির্ভর! ১৯৭৬ সালে ইরানের রপ্তানি আয়ের ৯৩ শতাংশের উৎস ছিল অপরিশোধিত জ্বালানী তেল! আর ২০১৬ সালে এই নির্ভরতা কমিয়ে ৬৩ শতাংশে আনতে সক্ষম হয় ইসলামী ইরান! 
এবার আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দেয়া পরিসংখ্যানের আলোকে ইসলামী ইরানের উন্নয়নের কয়েকটি প্রধান সাফল্যের সূচক তুলে ধরব। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ইসলামী বিপ্লবের আগে ১৯৭৭ সনে ইরানের জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করত। কিন্তু ২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী ইরানে দারিদ্রের হার ছিল মাত্র দশ দশমিক ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে এর এক বছর আগেও ব্রিটেনে দারিদ্রের হার ছিল ১৯ শতাংশ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই হার ১২ শতাংশ। গার্ডিয়ান পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী সৌদি আরবে ২০১৩ সালে সৌদি আরবের ২৫ শতাংশ জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। 
ইসলামী বিপ্লবের আগের তুলনায় ইরানে খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। কৃষি পণ্যের উৎপাদনও বেড়েছে চার গুণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন শ্রেণী-বৈষম্য বেড়েই চলেছে তখন ইরানে তা লক্ষ্যনীয় মাত্রায় কমেছে। যেমন, ১৯৮৬ সন থেকে ২০১৪ সাল নাগাদ ইরানে শ্রেণী বৈষম্য ৮ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। 
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ইরানের শাহ সরকার পশ্চিমা সংস্কৃতি ও অশালীনতা ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ইরানি চলচ্চিত্র ও নাটকে তখন নারীর সম্ভ্রমহানির দৃশ্য প্রায় বাস্তব ও রাখ-ঢাকহীনভাবে দেখানো হত! ইরানে সমকামিতারও প্রচলন ঘটানোকে উৎসাহ দিত এই সরকার। ১৯৬৮ সালে ইরানে দুই জেনারেলের পুত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে আলেম সমাজ ও ইরানি জনগণ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অফিস-আদালত, পার্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পথে-ঘাটে নারীর কোনো যথাযথ নিরাপত্তা ছিল না! আর ইসলামী বিপ্লবের পর এই অবস্থা হয়েছে পুরোপুরি বিপরীত।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ