গণহত্যার সেই নির্মম ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না
ইতালি কি ইথিওপিয়াকে ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু করবে?
১৯৩৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইতালীয় বাহিনী ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় তিন দিনের গণহত্যা শুরু করে। এই গণহত্যায় ইথিওপিয়ার ২০ হাজার মানুষ নিহত হন। ইতালির ইতিহাসে এই নির্মম গণহত্যার প্রসঙ্গটি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি, যেখানে এখনও উপনিবেশবাদের প্রতি সহানুভূতি-জাগানিয়া বক্তব্যেরই প্রাধান্য।
যেসব দেশ আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল তাদের মধ্যে ইতালি অন্যতম। ইতালির বেনিতো মুসোলিনি ইতালীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইথিওপিয়ায় ভয়ানক অপরাধ ও সহিংসতা চালায়। এসব অপরাধের মধ্যে গণহত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং কৃষি পণ্য ধ্বংস করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইথিওপিয়ার জনগণের প্রতিরোধ ব্যর্থ করতে দিতে এ ধরণের নৃশংস পথ নিয়েছিল ইতালি। ইতালীয় বাহিনী পরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধকামী নেতাদের গ্রেফতার করে এবং সোমালিয়ার দানানের মতো ভয়ঙ্কর শিবিরে নির্বাসিত করে।
আদ্দিস আবাবায় ইথিওপিয়ার ভাইসরয় এবং ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকার গভর্নর-জেনারেল রোডলফো গ্রাজিয়ানিকে হত্যার প্রচেষ্টার পর ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা ঘটে। ইরিত্রিয়ার দুই দেশপ্রেমিক ব্যক্তি গ্রাজিয়ানিকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। এর ফলে সাতজন নিহত হয় এবং গ্রাজিয়ানিসহ আরও অনেকে আহত হয়। এই ঘটনার কারণে ইতালীয় বাহিনী নৃশংসতম গণহত্যা চালায় এবং মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ইথিওপিয়াতে ইতালীয়দের গণহত্যা ও নির্যাতনের নানা ঘটনা বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শীরাও লিখে গেছেন। মার্কিন ও ফরাসি কূটনীতিকরাও এই অপরাধের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন প্রতিনিধি টেলিগ্রাফ করে ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন ইতালীয়রা নির্দয়ভাবে মানুষকে গুলি করছে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফরাসি কূটনীতিক লিখেছেন, বহু মৃতদেহ জড়ো করে সেগুলোতে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইথিওপিয়া পরবর্তীতে ইতালীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শীতল যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ইতালির প্রতি মিত্র শক্তির সমর্থনের কারণে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইথিওপিয়ায় গণহত্যা চালানোর জন্য অনেক ইতালীয় অপরাধীর বিচারতো দূরের কথা বরং ইতালিতে তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
ইচ্ছা করেই সেই নৃশংসতার ইতিহাস মানুষকে জানতে দেওয়া হয় না। ইথিওপিয়ায় ইতালীয়দের বর্বরতার ইতিহাস ভুলিয়ে রাখতে সেখানে দরিদ্র ইতালীয় অভিবাসীদের মাধ্যমে অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভূমি উন্নয়নের গল্প বলা হয়।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুগুলোতে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' এর মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয়দের নানা অপকর্মের ইতিহাস আবারও সামনে এসেছে এবং তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। এ ধরণের আন্দোলন ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে তিক্ত ইতিহাসের নানা পর্যায় পর্যালোচনা করে শিক্ষা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের দাবি জোরদার হয়েছে।
ইতালিতেও এ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে রোম সিটি কাউন্সিল ঔপনিবেশিক স্থানগুলোর নাম সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 'ইয়েকাটিট টুয়েলভ-নাইনটিন ফেব্রুয়ারি' নেটওয়ার্কের প্রচেষ্টার ফলে এ ধরণের কিছু পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে। এই নেটওয়ার্ক ঔপনিবেশিকতার নানা নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোচনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে।
এইভাবে হয়তো ইতালীয়রা তাদের ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘৃণ্য ইতিহাস এবং এর প্রভাব সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে। এর মধ্যদিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও জাতিগুলো ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। #
পার্সটুডে/এসএ/১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।