মার্চ ১০, ২০২১ ২১:০০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ঐতিহাসিক প্রদেশ হরমুজগানের বিখ্যাত শহর বন্দর আব্বাসের পাশে অবস্থিত দ্বীপাঞ্চলীয় আরেকটি পর্যটন শহর কেশমে। এখানকার কয়েকটি জিওপার্কের একটি হলো 'কেশম ওয়ার্ল্ড জিওপার্ক'। এটি নামকদন গুহা, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, তানদিশা উপত্যকা, সেতারেহ উপত্যকা, চককুহ স্ট্রিট, মাটির অঞ্চল, কাঁকড়া শিলা, শুর উপত্যকা, ডোকোহাক, করকুলা মাউন্টেন, কেশম ছাদ সহ বিশটিরও বেশি জিওসাইট  নিয়ে গড়ে উঠেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জিওপার্কটি কেবল এই দ্বীপেরই আকর্ষণীয় বিষয় নয় বরং সমগ্র ইরানেও এটি অনন্য। এই জিওপার্কটি মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র জিওপার্ক যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড জিওপার্কসের তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে। গত আসরে আমরা এই জিওপার্কের নামাকদন গুহার ভেতরের দৃশ্য এবং এখানকার ঝরনার কথা বলেছিলাম। এই ঝরনা সারা বছর ধরেই প্রবাহিত হয়। পানির এই ধারাটি লবণ গুহার অভ্যন্তরের অংশগুলোতেও দেখা যায়। কখনও কখনও গুহার নুনের জল এতো আয়নার মতো স্বচ্ছ যে নিজের চিত্রও সেই জলে প্রতিবিম্বিত হয় স্পষ্টভাবে। এই স্বচ্ছতা গুহার ভেতরের  পরিবেশকে দিয়েছে অপূর্ব সুন্দর এক চেহারা।

নামাকদন পাহাড়ের ভেতরের অংশে জলের প্রবাহ রয়েছে যা পার্শ্ববর্তী লবণের সাথে মিশ্রিত হয়ে গুহা থেকে একটি ঝরনাধারার আকারে বেরিয়ে এসেছে। এই ঝরনাধারা নামাকদান পর্বতের পাদদেশে একটি প্রাকৃতিক পানির হাউজ তৈরি করেছে। এই পানির নোনতা বৈশিষ্ট্যের কারণে পুকুরটিও সাদা হয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে এই ঝরনা ধারাটি সারা বছরই প্রবাহিত হয়। এই ঝরনাধারার প্রধান বিছানা বা গর্ভ লাল রঙের এবং এখানে অদাহ্য  মাটি মানে যে মাটি পোড়া যায় না সেরকম মাটির পলল দেখতে পাওয়া যাবে। এই পললগুলোতে আয়রন-অক্সাইড যৌগিক বিশেষ করে হেমাটাইট থাকে। নামাকদন গম্বুজের পাশে এবং এর উপকূলের দিকে বেশ কিছু চমক দেখতে পাওয়া যায়। এমন এক দর্শনীয় বিষয় হলো এখানকার চকচকে কণা এবং রুপার মতো উজ্জ্বল কিছু খনিজ বস্তু যা সাধারণত সমুদ্র সৈকতের বালির উপরে জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়। এগুলো এখানে একটি সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করেছে।

নামাকদন গুহায় ভেতরে যে লবণ রয়েছে সেটি আমাদের খাবার উপযোগী সর্বোত্তম লবণ। মজার ব্যাপার হলো এই লবণে ম্যাগনেসিয়ামের মতো অন্যান্য উপাদানও রয়েছে। যে কারণে নামাকদন গুহার লবণকে মেডিকেল লবণ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। যারা খেলাধুলা করে তাদের জন্য এই লবণ খুবই উপযোগী। এ ছাড়াও এই নামাকদন গুহার লবণ শ্বাস প্রশ্বাসের রোগী এবং হাঁপানি রোগীদের জন্যও খুবই ভাল।

নামাকদন গুহার লবণের উপকারিতার কথা বলছিলাম আমরা। এখানে রয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট 'হারা'। নিঃসন্দেহে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এবং এর বিরল ও নজিরবিহীন সুন্দর গাছ-গাছালি দেখার মতো। বিখ্যাত ইরানী বিজ্ঞানী আবিসিনা মেরিনা বা আবু আলী সিনা নামে পরিচিত এক প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ এই কেশম দ্বীপের অন্যতম বিস্ময় হিসেবে পরিগণিত। কেশম দ্বীপ ভ্রমণে যারাই যান তাদেরই পরিদর্শন কর্মসূচিতে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সর্বাগ্রে স্থান পায়। বাইশ হাজার কিলোমিটার আয়তনের এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কেশেমের অন্যতম বিস্ময়কর আকর্ষণ। পারস্য উপসাগর এবং ওমান সাগরের উপকূল জুড়ে বিস্তৃত এই বনটি। পানির মাঝেই এই হেরা বন গড়ে উঠেছে।

বিশ্বের বিরল একটি ঘটনা এটি। সে কারণে বিশ্ব তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এই হারা বন। তাই এই বন এখন পরিবেশ বিষয়ক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত রয়েছে। বনের দুই হাজার চার শ হেক্টর পরিমাণ অংশ কেশম দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে পড়েছে। বনটির আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো এটি সমুদ্রের জোয়ার জোনে অবস্থিত। যার ফলে জোয়ারের সময় পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়ে বনটি পানির নীচে ডুবে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার ভাটার সময় পানির স্তর ধীরে ধীরে নেমে গেলে গাছগুলি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই বনের গাছগুলির রঙ সারা বছর ধরেই সবুজ থাকে।  গাছগুলো তিন থেকে ছয় মিটার লম্বা হয়। এর বেশি লম্বা হয় না খুব একটা।

হারা শ্যানগ্রোভ ফরেস্টের গাছগুলোর সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। এই গাছগুলোর আকর্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হলো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এগুলো লবণাক্ত পানির সঙ্গে নিজেদেরকে ভালভাবে মানিয়ে নিয়েছে। লবণাক্ত পানি থেকেই যেহেতু এরা প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করে তাই এই গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে লবণ ছেঁকে বিশুদ্ধ ও মিষ্টি করে নেয়। ভ্রমণকারীরা যখন বোটে করে এই সবুজ বনের ভেতর দিয়ে পাড়ি জমান তারা এক অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। আসলে পানিতে গড়ে ওঠা সবুজ বন তার ভেতর দিয়ে নৌকা ভ্রমণের যে অপূর্ব অভিজ্ঞতা সেটা বর্ণনা করে কতটুকুই বা বোঝানো যায়। এটা ভ্রমণ করে উপলব্ধি করার মতো একটি ব্যাপার। যাদের সেই সুযোগ আছে বা ভবিষ্যতে যাদের সুযোগ সৃষ্টি হবে তারা সরাসরি বন ভ্রমণে চলে যাবেন এমন অভিজ্ঞতার কথা লিখে আমাদের জানাবেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ