নভেম্বর ৩০, -০০০১ ০৩:০৪ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা?  আশা করি এ মুহূর্তে যারা রেডিও, ইন্টারনেট অথবা ফেসবুক লাইভে আমাদের অনুষ্ঠানে শুনছো সবাই ভালো ও সুস্থ আছো। তোমাদেরকে আজকের অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য তোমরা নিশ্চয়ই নানা ধরনের খেলাধুলা করে থাকো। অনেকেই আবার শক্তিমত্তা ও বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে কঠিন কিছু খেলায় অংশ নেয়। এগুলোর মধ্যে কুস্তি অন্যতম। ঐতিহাসিক মতে, ১৫ হাজার বছর পূর্বে প্রথম ফ্রান্সে উৎপত্তি হয়েছিল কুস্তি খেলা এবং আজকে যার আধুনিক রূপ রেসলিং। বর্তমান বিশ্বে বিনোদনের এক প্রধান মাধ্যম এটি। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত টিভিতে রেসলিং দেখে মজা পান। রেসলারদের শক্তিসামর্থ্য, তাদের মার হজম করার ক্ষমতা, মারের টেকনিক দেখে অনেকেই অবাক হন। অনেকে আবার তাদের প্রিয় রেসলারের জয়ে আনন্দিত হয় আবার পরাজয়ে কষ্ট পায়। তবে রেসলিংয়ের সবচেয়ে গোপন বিষয়টি হয়তো তোমরা অনেকেই জানো না।

বন্ধুরা, তোমরা হয়ত বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, রেসলিং কোনো খেলা নয়। এটি একটি পাতানো খেলা। তোমরা টিভিতে যে রেসলিং দেখে থাকো, তা দর্শক আনন্দ দেয়ার জন্য আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা হয়। এই রেসলিং আন্তর্জাতিকভাবে খেলা হিসেবে স্বীকৃত নয়, এটি দর্শক বিনোদনের জন্য শুধুমাত্রই অভিনয়। তবে অলিম্পিক বা ফিলো’র তত্ত্বাবধানে যে কুস্তি প্রতিযোগিতাগুলো অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো আলাদা। কারণ, এগুলো সত্যিকারের কুস্তির লড়াই।

বন্ধুরা, কুস্তি নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য তোমরা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছো? হ্যাঁ, রংধনুর আজকের আসরে রয়েছে এক কুস্তিবিদ ও তার সাগরেদের গল্প। আর গল্প শেষে থাকবে ফিলিস্তিনি শিশুদের নিয়ে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

কুস্তি খেলার একটি দৃশ্য

প্রাচীনকালে এক বৃদ্ধ কুস্তিগীরের বেশ নামডাক ছিল। কুস্তি খেলায় অসামান্য পারদর্শিতার জন্যই ওই নামডাক। কোনো কুস্তিগীরই তার সাথে কুস্তি খেলায় পেরে উঠতো না। যত বড় পালোয়ানই ছিল না কেন তাঁর সাথে খেলায় প্রতিযোগিতা করে মাটিতে লুটিয়ে পড়া ছাড়া জিততে পারে নি কেউ। এভাবে সেই কুস্তিগীর কুস্তি শিল্পের মস্ত বড় শিল্পী হয়েছিলেন। সবাই তাকে কুস্তির ওস্তাদ বলে মেনে নিয়েছিল।

যে কোনো খেলারই কিছু কৌশল আছে। কৌশল ছাড়া কোনো শিল্পই ঠিক উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। বৃদ্ধ কুস্তিগীর এরকম বিচিত্র কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। বলা হত তিনশ' ষাটটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল মানে আর্ট জানতেন তিনি। এইসব কৌশলের কিছু কিছু তিনি তাঁর শিষ্যদেরকেও শিখিয়েছিলেন।

তিনি নিরিবিলি এবং প্রশান্ত পরিবেশে তাঁর যুবক শিষ্যদেরকে এসব আর্ট বা খেলার কলাকৌশল শেখাতেন। যখন তিনি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর্যায়ে গিয়েছিলেন তখন আর তিনি নিজে কুস্তি খেলতেন না। সকল কুস্তিগীর তাঁকে বিরল সম্মান করত এবং একবাক্যে কুস্তিবীর ওস্তাদ বলে স্বীকার করত।

খ) ভালো ছাত্রের প্রতি যে কোনো শিক্ষকের যেমন এক ধরনের সুনজর থাকে কুস্তিগীর ওস্তাদেরও সেরকম ছিল। তাঁর শাগরেদদের মাঝে যে একটু ভালো ছিল তার প্রতি ওস্তাদ একটু বেশি খেয়াল রাখতেন এবং তিনি যত যত কৌশল জানতেন তাকে সবার আগে শেখানোর চেষ্টা করতেন। কেননা তিনি জানতেন ওই শাগরেদ একদিন নাম করবে। তার ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। অদূর ভবিষ্যতে সেও ভালো কুস্তিগীর হবে এবং সে তার ওস্তাদের নাম রাখবে। স্বাভাবিকভাবেই যে শাগরেদের প্রতি ওস্তাদের সুদৃষ্টি পড়বে সে যে ধীরে ধীরে কুস্তিবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠবে তাতে আর সন্দেহ কী!

প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ যেসব প্রতিযোগিতা হতো সেগুলোতে সে সহজেই অন্যদের হারিয়ে বিজয়ী হত। যুবক কুস্তিগীরের ক্রম উন্নতি ও সাফল্য দেখে বৃদ্ধ ওস্তাদ সিদ্ধান্ত নিল যত রকম কলাকৌশল তাঁর জানা আছে সব ওই মেধাবী শাগরেদকে শেখাবে।

যুবক এ বিষয়টা জানতে পেরে যারপরনাই খুশি হয়ে গেল। যুবক জানত তার ওস্তাদ খুব কম শাগরেদকেই তাঁর সকল কলাকৌশল শেখাতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ওস্তাদ তাঁর ওই যুবক শাগরেদকে সকল কলাকৌশল শেখালেন। যুবক যখন বুঝতে পারল সে ওস্তাদের কাছ থেকে কুস্তি খেলার কলাকৌশলগুলো সবই আয়ত্ত করে ফেলেছে তখন তার রূপ ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করল।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, শয়তান সবসময়ই মানুষের পিছে লেগে থেকে শুধুই প্ররোচনা দিতে থাকে। সেই প্ররোচনায় কেউ পড়ে যায় কেউ এড়িয়ে যায়। যুবক কুস্তিগীরও শয়তানের প্ররোচনা এড়াতে পারল না, সে ভীষণ অহংকারী হয়ে উঠল। আর কে না জানে অহংকার যার ভেতর একবার বাসা বাঁধে সে আর উন্নতি করতে পারে না, ধ্বংস হয়ে যায়। আর বিনয় মানুষকে বড় করে, উন্নত করে।

যুবক কুস্তিগীর অহংকারে ডুবে গিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে পারদর্শী, শক্তিমান এবং কৌশলী কুস্তিগীর হিসেবে ভাবতে শুরু করে দিল। ওস্তাদ তাকে যেসব কলাকৌশল শিখিয়েছিল সেগুলো প্রয়োগ করে একের পর এক বিজয় অর্জন করার পরিপ্রেক্ষিতেই সে নিজেকে এভাবে অহংকারী কুস্তিগীর হিসেবে মনে করতে লাগল। লাগাতার বিজয়ের ক্ষতিকর দিক এটা। অহংকার থেকে মুক্ত থাকার স্বার্থে তাই মাঝে মধ্যে পরাজয়টাও মন্দ নয়। 

বিজয়ের গর্বে মত্ত হয়ে শাগরেদ তার ওস্তাদকে অসম্মান করতে শুরু করল। ভুলেই গিয়েছিল যে, সে ওস্তাদের কাছ থেকেই শিখেছে সব। যখনই কোথাও বসত, কথাবার্তা বলত, তখনই সে গর্ব করে বলত: এই পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে কৌশলী, শক্তিমান এবং শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। ওস্তাদের কথাটা আর মুখে আনত না। যদি কখনও ভুলে ওস্তাদের নাম উচ্চারণ করে বসত, বলত: আমি আমার ওস্তাদের চেয়ে কুস্তি খেলার কলাকৌশল অনেক বেশি জানি। তাঁকে সম্মান করি শুধু এজন্য যে, তিনি একজন প্রথম সারির কুস্তিগীর ছিলেন। তা না হলে উনি আমার পায়ের সমতুল্যও নন।

একদিন ওই যুবক বাদশাহর সামনে এরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং অহংকারী কথাবার্তা বলায় বাদশাহ’র রাগ হলো। বাদশাহ সাথে সাথে আদেশ দিল ওই যুবক যেন তার ওস্তাদের সাথে কুস্তি প্রতিযোগিতায় লড়ে।

বাদশাহ ছিল দূরদর্শী। সে জানত এই প্রতিযোগিতায় ওস্তাদের কাছে তার অহংকারী শাগরেদ নির্ঘাত হারবে। সুতরাং যুবকের অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং আর কোনোদিন এরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলবে না। শিক্ষা হবে যুবকের।

বাদশাহর আদেশ অনুযায়ী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো এবং যথাসময়ে শুরু হয়ে গেল ওস্তাদ শাগরেদের কুস্তি প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতা দেখার জন্য মানুষের ঢল নামল। স্বয়ং বাদশাহও ওই প্রতিযোগিতা দেখার জন্য গ্যালারিতে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসল। যারা সে সময়কার শক্তিমান কুস্তিগীর ছিল তারাও তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর ওই যুবক এবং তার ওস্তাদের মধ্যকার কুস্তি খেলা দেখার জন্য এসেছিল।

যুবক তখন বেশ স্বাস্থ্যবান এবং দীর্ঘদেহী ছিল। খেলার মাঠে সে আগে প্রবেশ করল। ওস্তাদের দৃষ্টি যখন শাগরেদের সুঠাম বাহুর ওপর পড়ল তখন বুঝতে পারল যে, ওই শক্তিশালী বাহুর শক্তির কাছে তার বৃদ্ধ বয়সের শক্তি কিছুই না। অতএব যদি বাহুবলের কৌশলের ওপর নির্ভর করে কুস্তি খেলা হয় তাহলে তাঁর হার নিশ্চিত। তাই কৌশল পাল্টাতে হবে। বুদ্ধি খাটাতে হবে ঠিক কোন কৌশলে যুবককে ধরাশায়ী করা যায়।

ঘটা করে কুস্তি খেলা শুরু হয়ে গেল। গ্যালারি ভর্তি দর্শকের চিৎকার, হৈ হুল্লোড়ের ভেতর কুস্তি খেলছে ওস্তাদ-শাগরেদ। কে হারে কে জেতে- এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলী হয়ে উঠল সবাই। বেশিরভাগ দর্শকই বলছিল বৃদ্ধ ওস্তাদের পরাজয় নিশ্চিত। এ নিয়ে বাজি ধরাধরি হয়ে গেল। বাজিতে বেশিরভাগই ছিল যুবকের পক্ষে এবং সেটাই স্বাভাবিক। যুবকের পক্ষে বাজি ধরলেও মনে মনে কিন্তু বৃদ্ধ ওস্তাদের বিজয় কামনা করছিল সবাই। ওস্তাদের সম্মান যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয় বরং অটুট থাকে সেটাই কামনা করছিল অনেকে। ওস্তাদ তার শাগরেদের সাথে মিশে গিয়ে এমনভাবে কৌশল প্রয়োগ করল যে, শাগরেদ কিছুতেই তা প্রতিহত করতে পারল না।

ওস্তাদ শাগরেদের টুটি চেপে ধরল। দু’হাতে ধরে মাথার ওপর তুলে মাটিতে আছাড় মারলো। দর্শকরা মহানন্দে চিৎকার করে উঠল এবং ব্যাপক হাততালি দিয়ে বৃদ্ধ ওস্তাদকে প্রাণিত করে তুলল। এভাবে ওস্তাদ জিতে গেল খেলায়। যুবক কোনো কৌশলই প্রয়োগ করার সুযোগ পেল না।

বাদশাহ ওস্তাদের বিজয়ে খুশি হয়ে মাঠে নেমে এসে বৃদ্ধের সাথে হাত মেলাল এবং আদেশ দিল ওস্তাদকে বীরত্বের সোনালী গাউন উপহার দিতে। আর যুবককে তিরষ্কার করল এই জন্য যে, সে ওস্তাদের অমর্যাদা করেছিল।

যুবক বাদশাহকে বলল: এই বৃদ্ধ কুস্তিগীর শক্তিতে আমার সাথে জেতেনি। ও জিতেছে এমন এক কৌশলে যে কৌশলটা সে আমাকে শেখায়নি, আমি জানতাম না কীভাবে ওরকম অ্যাকশন প্রতিহত করতে হয়।

বৃদ্ধ ওস্তাদ জানতো এরকম একটা দিন আসবে। অকৃতজ্ঞ শাগরেদ একদিন ওস্তাদকে অস্বীকার করবে এবং ওস্তাদকে একদিন চ্যালেঞ্জ করে বসবে। সেজন্য ওস্তাদ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এবং ওস্তাদ যে তিনশ' ষাটটি কৌশল জানত তার মধ্য থেকে তিনশ উনষাটটি শাগরেদকে শিখিয়েছিল, একটি বাদ রেখেছিল এই দিনটির জন্য।

বৃদ্ধ ওস্তাদ বাদশাহর পাশে দাঁড়িয়ে শক্তিমান যুবককে বললেন: এখন বুঝতে পেরেছো, কেন আমি তোমাকে শেষ কৌশলটা শেখাইনি? শোননি মুরব্বিরা বলে গেছেন: ‘বন্ধুকে এতোটা ক্ষমতা দিও না, যাতে কখনো তোমার শত্রু হয়ে গেলে তোমার ওপর বিজয়ী হতে না পারে।

বন্ধুরা, দুষ্টু ও অহংকারী শাগরেদের ওপর ওস্তাদের বিজয়ের কাহিনী শুনলে। যুগে যুগে এভাবেই অহংকারী ও জালিমদের বিরুদ্ধে মজলুম ও নির্যাতিত মানুষরা বিজয়ী হয়েছিল। এর প্রমাণ তোমরা কিছুদিন আগে ফিলিস্তিনে দেখেছো। 

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে অসহায় ফিলিস্তিনি শিশুদের নিয়ে লেখা একটি গান। গানের কথা ও সুর আবদুল গাফফারের। আর গেয়েছে বাংলাদেশি শিশুশিল্পী হুমায়রা আফরিন ইরা। 

বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।#

 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।