আগস্ট ২৬, ২০২১ ১৬:৫১ Asia/Dhaka

আজকের আসরে আমরা মার্কিন সমাজে বন্দুক তথা আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সহিংসতাকে মহামারি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পত্রপত্রিকাতেও এ বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি হচ্ছে। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন টাইম এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে লিখেছে, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা এখনই থামাতে হবে। টাইমের প্রচ্ছদে সেদেশে ব্যাপক গুলির ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। এক বছর ধরে যেসব এলাকায় ব্যাপকভাবে গুলির ঘটনা ঘটেছিল সেগুলোর নাম দিয়ে প্রচ্ছদটি সাজানো হয়। এরপর বড় অক্ষরে লেখা হয় এনাফ অর্থাৎ যথেষ্ট। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বিশেষকরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা এখন প্রতিদিনের স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেদেশে গোলাগুলিতে ব্যাপক হত্যা যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো- সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে সেদেশের সমাজ এসব হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোলাগুলির ৭২ ঘণ্টার একটি চিত্র তুলে ধরলেই এর ব্যাপকতা সবার সামনে স্পষ্ট হবে।

চলতি ২০২১ সালের ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই- এই তিন দিনে অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের বরাত দিয়ে মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন জানিয়েছে, এই তিন দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চার শতাধিক গুলির ঘটনা ঘটেছে। তারা বলেছে, শিকাগোতে তুলনামূলক বেশি গুলি ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শিকাগো হচ্ছে আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। এ শহরে ৪ জুলাই একদিনে মোট ৮৮ জনকে গুলি করা হয়েছে। এতে মারা গেছেন ১৪ জন। সহিংসতার পরিমাণ বেড়েছে নিউইয়র্কেও। সেখানকার পুলিশ দপ্তর জানিয়েছে, এ শহরে তিন দিনে ২১টি স্থানে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহত হয়েছেন ২৬ জন। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে যারা নিহত হন তাদের একটা অংশ হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বন্দুকের গুলিতে কমপক্ষে এক হাজার তিনশ শিশু নিহত হয়। কয়েক বছর আগে মার্কিন সরকারের তৈরি করা এক পরিসংখ্যানেই এ কথা বলা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর পাঁচ হাজার আটশ' শিশু বন্দুকের গুলিতে গুরুতর আহত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে যেসব শিশু নিহত হচ্ছে তাদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশ দুর্ঘটনাবশত। বাকিগুলো হত্যাকাণ্ড কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনা। এক বছরের  শিশুরাও বন্দুক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। গবেষক ক্যাথরিন ফোলার জানিয়েছেন, প্রতিবছর আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রতিদিন ১৯জন শিশু আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মারা যাচ্ছে নয়তো গুরুতর আহত হচ্ছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিশুরা যখন তাদের পরিবার কিংবা ছেলে বন্ধু এবং মেয়ে বন্ধুর সাথে সম্পর্ক নিয়ে জটিলতার পড়ে তখন তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান শিশুদের আত্মহত্যার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।

আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে কোন রাজ্যে শিশু নিহত হবার প্রবণতা বেশি সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিসট্রিক্ট অব কলম্বিয়া এবং লুইজিয়ানায় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশুমৃত্যু বেশি হয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। কিন্তু সারা পৃথিবীর ৪২ শতাংশ বন্দুক রয়েছে আমেরিকায়। ২০১৫ সালে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম ল্যাঙ্কফোর্ড পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৬৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে গোলাগুলির ৩১ শতাংশ ঘটেছে আমেরিকায়।  এতো মৃত্যুর পরও আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

মার্কিন জনগণের একটা অংশও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে তারা বিশ্বাস করেন না। তাদের মতে, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করা হলেও এমন হত্যাকাণ্ড ঘটতেই থাকবে। তাদের অনেকের কাছেই ব্যক্তিগত অস্ত্র একটি সম্মানের কারণ। এটা বহু মানুষের অবসর কাটানোর সঙ্গী। তারা অস্ত্রকে আত্মরক্ষার মূল মাধ্যম হিসেবে দেখে। আসলে এটা বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে, এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণেই গুলিতে এত বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংস্কৃতি মার্কিন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এ কারণে এই সমস্যার সমাধান সহজে হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বহন অধিকারের প্রধান মুখপাত্র সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ সব সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  প্রতি বছর তারা এই কাজে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে তাদের শক্তিশালী লবি।

ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও ‘আমেরিকার বন্দুক সংস্কৃতি’ গ্রন্থের লেখক জিমি টেইলর বলেছেন, কোনো পরিবর্তনের আশা কেবল চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বড় কোনো সংস্কার আনতে হলে, এমনকি প্রেসিডেন্ট নিজেই উদ্যোগ নিলেও তা পাস করাতে অনেকগুলো আইনি ও প্রশাসনিক বাধা মাড়াতে হবে। আমেরিকার বন্দুক অধিকার কর্মীরা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রয়োজন নেই। আইন করে কখনও অপরাধীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারও মানসিকতাও পরিবর্তন করা যায় না। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ