আগস্ট ২৮, ২০২১ ১৮:০১ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি সবাই ভালো ও সুস্থ আছ। প্রতি সপ্তাহ’র মতো আজও রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ-সবাই গভীর আগ্রহ-উদ্দীপনা ও কৌতূহলী মন নিয়ে গল্প শুনতে ভালোবাসে। শিক্ষণীয় গল্প, অনুপ্রেরণামূলক, সফলতার গল্প এমনকি রূপকথার গল্পও অনেকে ভালোবাসে। 

মানুষের এই কৌতূহল ও ভালোবাসাকে পুঁজি করেই গল্পকারগণ নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনকে গল্পের ভেতর ব্যক্ত করার সুযোগকে কাজে লাগান। পবিত্র কুরআনেও শিক্ষণীয় বহু গল্পের অবতারণা করা হয়েছে, সুন্দর এবং মার্জিতভাবে। এসব গল্পের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ, নবী-রাসূলদের নবুয়্যতির প্রমাণ, আখেরাতের প্রমাণপঞ্জী, আল্লাহর অবাধ্যতার পরিণতিসহ নানা বিষয় চমৎকারভাবে  বর্ণনা করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনের গল্পগুলো কিন্তু নিছক কল্পনাপ্রসূত কথা সাহিত্য নয়। এই কাহিনীগুলোর সবই মানব মানবজীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা। কুরআনের গল্পগুলোতে মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করার লক্ষ্যে এবং সঠিক হেদায়েতের পথ প্রদর্শনের জন্যে বিভিন্ন চরিত্রকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আজকের আসরে আমরা পবিত্র কুরআন থেকে নেওয়া দুটি গল্প শোনাব। এছাড়া থাকবে মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিয়ে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

আগুনে পোড়ানো বাগা

মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি জীবের বেঁচে থাকা এবং সুস্থতার জন্য নানারকম উপাদান পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, "তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টি জীবের জন্য। এতে রয়েছে ফলমূল এবং আবরণযুক্ত খেজুর-বৃক্ষ এবং খোসাবিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধি ফুল। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্‌ কোন্‌ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে"?

পবিত্র কুরআনের এ ঘোষণার পরও মানুষ মহান আল্লাহর অনুগ্রহের কথা অস্বীকার করে। পবিত্র কুরআনের সূরা কলম-এ এক বাগানের মালিকদের পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে- যারা গরিব-দুঃখীদের নিজ বাগানের ফল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আসরের প্রথমেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি শোনা যাক।

অনেকদিন আগের কথা। ইয়েমেন দেশে এক গ্রামের নাম ছিল শারওয়ান। ওই গ্রামে ছিল ফুলে ফলে ভরা একটি বাগান। হরেক রকম গাছ-গাছালির বিরাট বাগানটি দেখলে যে কারো প্রাণ জুড়াতো। বাগানের মালিক ছিলেন একজন দানশীল বৃদ্ধ। তাঁর নিয়ম ছিল- ফলমূল তোলার সময় হলে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় ফলমূল রেখে দিয়ে বাকীগুলো ফকীর-মিসকিন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। প্রতি বছর ফসল তোলার সময় হলেই অভাবী মানুষজন সেই বাগানে জড়ো হতো এবং ফলমূল সংগ্রহ করতো।

এভাবে অনেক দিন যাওয়ার পর আল্লাহর ওই দানশীল বান্দাহ একদিন মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন। তিনি তাঁর সন্তানদের ডেকে কিছু উপদেশ দিলেন। জীবনের অন্তিম উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, "তোমরা গরীব-মিসকিনদের হক আদায় করবে। তাদেরকে কখনো বঞ্চিত করবে না।"

এ কথা বলেই বৃদ্ধ মহান প্রভূর দরবারে চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুর পর বাগানের মালিকানা চলে আসল ছেলেদের হাতে। কিন্তু খুব শিগগিরই তারা পিতার উপদেশের কথা ভুলে গেল। তাদের একজন ছাড়া বাকী সবাই শপথ করে সিদ্ধান্ত নিল, খামাখা অভাবী লোকদের তারা কিছুই দেবে না।

এরপর যখন ফসল তোলার সময় এল তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলে, ভোরে ফকির-মিসকিনরা টের পাওয়ার আগেই তারা বাগান থেকে সব ফল সংগ্রহ করে ফেলবে।

বাগান মালিকদের এ ফন্দির কথা ফকির মিসকিনরা জানতে না পারায় তারা ফলমূল নেয়ার জন্য বাগানে আসতে লাগল। কিন্তু বাগানে কাউকে না না দেখে তারা হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে গেল।

এদিকে বাগান মালিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে গরীব-মিসকিনরা খালি হাতে ফিরে যাওয়ায় মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন। একরাতে তিনি ওই বাগানে একটি ভয়াবহ ঝড় পাঠালেন। ঝড়ের সময় বজ্রপাতের ফলে বাগানে আগুন লেগে সব গাছ পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

বাগান মালিকরা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে একে অপরকে ডাকতে লাগলে। সবাই ওঠার পর তারা একসাথে ফল সংগ্রহের জন্য বাগানের দিকে রওনা হলো। কিন্তু তারা জানতো না যে, ঝড় ও বজ্রপাতের আঘাতে রাতেই বাগানটি জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

তারা খুব সতর্কতার সাথে বাগানের দিকে এগিয়ে চলল। তাদের একজন ফিসফিস করে বলল, সতর্ক থাকবে আজ একজন ফকীরও যেন বাগানে প্রবেশ করতে না পারে।

বাগান মালিকরা যখন বাগানে গিয়ে প্রবেশ করলো তখন তারা দেখতে পেলো যে, আগুনের হলকা লেগে পুরো বাগানটি ভস্ম হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে তারা অবাক হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথাই বলল না। তাদের একজন বলল, আমরা মনে হয় ভুল করে অন্য কারো বাগানে এসে পড়েছি। কিন্তু তাদের বড়ভাই বলল, আমি কি তোমাদের আল্লাহর গুনগান করতে এবং গরীবদের ফলমূল দেয়ার জন্য বলিনি? এখন দেখলে তো, অতিরিক্ত লোভ করতে গিয়ে কি পরিণতি হলো?

বড় ভাইয়ের কথা শুনে সবার চেতনা ফিরে এলো। সবাই বলল, ‘আমরা অনেক বড় অপরাধ করেছি; নিজেদের ওপর জুলুম করেছি এবং সীমা লংঘন করেছি।

এরপর তারা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করল। নিজেদের ভুল স্বীকার করে মাফ চাইল। তারা অঙ্গীকার করল-তাদেরকে একটি বাগান দেয়া হলে তারা গরীব-মিসকিনদের সাধ্যমত ফলমূল দেবে। মহান আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করলেন এবং একটি মনমুগ্ধকর বাগান তাদেরকে দান করলেন।

এ ঘটনাটি সূরা আল কলমের ১৭ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ঘটনাটি থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, গাছের ফল গরীব-দুঃখী ও অভাবী মানুষদের মাঝে দান করা উচিত। তা না হলে গরীবরা যেমন কষ্ট পান তেমনি মহান আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন।

দুই বাগানের অহংকারী এক মালিক

বন্ধুরা, এবার আমরা অহংকারী এক বাগান মালিকের গল্প শোনাব। গল্পটি পবিত্র কুরআনের সূরা আল কাহাফে বর্ণনা করা হয়েছে।

অনেক অনেক দিন আগের কথা। দুই বন্ধু এক সঙ্গে বসবাস করতেন। তারা ছিল একে অপরের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু। একজন ছিল প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী। সবুজ শ্যামল সতেজ সুজলা-সুফলা ফলমূলে ভরা শস্য ক্ষেতের মালিক। তাও আবার একটি নয়। দু'টি বাগানের মালিক।

পক্ষান্তরে তারই সাথী অপর বন্ধুটি ছিল বিত্তহীন। কিন্তু বিত্তহীন হলে কি হবে? ঈমানের বলে বলীয়ান ছিল তার অন্তর। তাওহীদের আলোয় আলোকিত ও কানায় কানায় ভরপুর। আল্লাহর স্মরণে সবসময় মশগুল থাকত সে। তার বন্ধুর মতো অহংকার করত না সে।

অহংকারী লোকটির দু'টি বাগানই ছিল চোখ জুড়ানো। খেজুর গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত দুই বাগানের মাঝেই ছিল চমকারিত্বের লীলাভূমি। নয়নাভিরাম সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত। উভয় বাগানই ছিল যেমন ফুলে ফলে ভরপুর তেমন ফাঁকে ফাঁকে ছিল প্রবাহিত স্রোত ধারা। যেন জান্নাতি নহর।

একদিন ফলবাগানের মালিক পাকা টসটসে ফল সংগ্রহ করতে গেল। কথা প্রসঙ্গে তার সাথীকে অহংকার প্রকাশ করতে গিয়ে বলল: “আমার ধন-সম্পদ তোমার চেয়ে অনেক বেশি। জনবলেও আমি বেশ শক্তিশালী।

সে আরও বলল: “আমার মনে হয় না এ বাগান কখনো ধ্বংস হবে। কখনো কিয়ামত সংঘটিত হবে। যদি কখনোইবা হয় এবং প্রতিপালকের কাছে পৌঁছে যাই; তাহলে সেখানেও এর চেয়ে ঢের বেশি বস্তু পাবো।

এভাবেই বাগান মালিক তার দাম্ভিকতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। এসময় হতদরিদ্র বন্ধুটি সাহসের সাথে তাকে স্বরণ করিয়ে দিল তার সৃষ্টির ইতিহাস। সে তাকে বলল: “তোমার অহংকার নিরর্থক ও সম্পূর্ণ বেমানান। তুমি আল্লাহকে কেন অস্বীকার করছ- যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। অতঃপর নাপাক পানি থেকে। তারপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন কতোইনা সুন্দর মানব আকৃতিতে? আমিতো শুধু এ কথাই বলি- মহান আল্লাহ আমাদের পালনকর্তা। তার সাথে আর কাউকে শরীক করি না।

দরিদ্র ও খোদাভীরু বন্ধুটি আরও বলল: “আল্লাহর শক্তি ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই। আমি আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে তোমার বাগানের চেয়েও উত্তম বস্তু দান করবেন। মনে রেখো! তোমার বাগানের ওপর আসমান থেকে আগুন পাঠাবেন। ফলে সকালে তা পরিষ্কার মাঠ হয়ে যাবে। অথবা সকালে তার পানি শুকিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি তার সন্ধান পাবে না। 

এসব কথা শোনার পরও অহংকারী বন্ধু যখন গর্বে তার পা মাটিতেই ফেললো না তখন তার ঈমানদার সাথী রাগে-ক্ষোভে বদদোয়া করে বাগান থেকে চলে গেল। এরপর দেখা গেল, মহান আল্লাহ মু'মিন ব্যক্তিটির দোয়া কবুল করেছেন। তার বাগানের সমস্ত ফলমূল ধ্বংস হয়ে গেছে।

বাগানের ব্যয় করা সম্পদের জন্য সকাল বেলা দু'হাত কচলিয়ে আক্ষেপ করতে লাগল অহংকারী লোকটি। অস্থির হয়ে পড়ল সে। টানতে লাগল মাথার চুলও। সে বলতে লাগল হায়! আমি যদি পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক না করতাম; তার শুকরিয়া আদায় করতাম; তাঁর শক্তির গুরুত্ব দিতাম এবং অহংকার থেকে মুক্ত থাকতাম; তাহলে আমার এ সর্বনাশ হতো না।

এ গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,  কৃতকর্মের জন্য পরে অনুশোচনা না করে আগেই সতর্কতার সাথে কাজ করা উচিত। মহান সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে থাকা কিংবা মনের ভুলেও অহংকারী না হওয়া যাবে না।

বন্ধুরা, পবিত্র কুরআন থেকে নেওয়া দুটি গল্প শুনলে। এবারে তোমাদের জন্য রয়েছেন কুরআনর পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি গান। গানের কথা লিখেছেন, বিলাল হোসাইন নূরী, সুর করেছেন মাহফুজ বিল্লাহ শাহী আর গেয়েছে শিশুশিল্পী আরোশি, শেমন্তি, সারা, মিম, তাইফা ও তাদের সঙ্গীরা। 

বন্ধুরা, সারেগাামা ঢাকার একাডেমি পরিবেশিত গানটি শুনলে। তোমরা সবাই কুরআন পড়তে এবং কুরআনের শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে কাজে লাগাবে এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।