সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১ ১৪:৫৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি এ মুহূর্তে যারা অনুষ্ঠান শুনছো তারা সবাই ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই রূপকথা শুনতে পছন্দ করো। আজকের আসরের প্রথমেই থাকবে 'পশুর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব' নিয়ে থাকবে একটি রূপকথা। এটি নেওয়া হয়েছে ইরানের বিখ্যাত ও বহুপ্রাচীন গ্রন্থ 'ইস্কান্দারনামা' থেকে। গল্পের পর থাকবে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর গানসহ সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই রূপকথার গল্পটি শোনা যাক।

একদিন বনের রাজা সিংহ তার গুহার পাশে বসে নিজ বাচ্চাদের খেল-তামাশা দেখছিল। হঠাৎ করে ওই পথ দিয়ে হুড়মুড় করে একদল বানর ও শিয়াল কোথা থেকে এসে ছুটে পালাচ্ছিল। সিংহ ওদের ডেকে বলল: কিরে! হয়েছেটা কি? ছুটে পালাচ্ছিস কেন?

ওরা বলল: ‘না কিছুই হয়নি। ওদিকে একটা মানুষ জঙ্গলের দিকে আসছে কিনা তাই দেখে ভয়ে পালাচ্ছি।‘

সিংহ আগে কখনো মানুষ দেখেনি। সে ভাবল মানুষ নিশ্চয়ই বিরাট দেহের কোনো জীবজন্তু। আর সিংহ বনের রাজা। গায়ের জোরে কেউ তার সাথে পারে না। তাই সে পলায়নরত পশুদের সান্ত্বনা ও অভয় দিয়ে বলল: ‘মানুষ আবার ভয়ের কী হলো?’

ওরা বলল: ‘আপনি ভয়ের পাল্লায় পড়েননিতো তাই ও কথা বলছেন। ওরা ভয়ানক প্রাণি। ওদের জোর সবারচে বেশি।‘

সিংহ বলল: ‘তোদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। মানুষতো কোন্ ছাড়, দেও-দানবও যদি হয়, তবু আমি এখানে থাকতে তোদের কোনো ভয় নেই।’

এর পরদিন সিংহ একাকী গুহা থেকে বের পড়ল মানুষ খুঁজে বের করতে। পথ চলতে চলতে দূর থেকে একটা হাতি দেখতে পেল। মনে মনে চিন্তা করল ওরা যে বলছে মানুষ খুবই ভয়ানক প্রাণি তবে নিশ্চয়ই এ ধরনের কিছু একটা হবে। তাহলে এই বিশাল দেহটাই কী মানুষ! সামনে এগিয়ে এসে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সিংহ বলল: অ্যাই! তোকেই কি মানুষ বলে?

হাতি বলল: না, আমি হাতি! দেখছো না শূড় আছে। আমি নিজেই মানুষের হাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। মানুষেরা এসে আমাদের ধরে পিঠের উপর পালঙ্ক বাঁধে। এরপর ওরা নিজেরা সেই পালঙ্কের উপর আসন গেড়ে বসে আমাদের মাথায় মুগুর পেটায় এবং পথ চলতে বাধ্য করে। বৃদ্ধ হলে আমাদের দাঁত উপড়ে ফেলে। এরকম হাজারো বালা-মুসিবত ঢেলে দেয় আমাদের উপর। আমরা কোথায় আর মানুষ কোথায়?

সিংহ: বেশ ভালো কথা। আমি তা জানি শুধু জানতে চেয়েছিলাম হঠাৎ করে দেহের ভারে নিজেকে মানুষ ভেবে বসেছিস কিনা।

হাতি: জনাব সিংহ কী যে বলেন!! ঘুণাক্ষরেও আমরা মানুষ হতে যাব না। ভুলেও এ ভুল করব না।

সিংহ: হয়েছে হয়েছে, বেশি কথা বলিস না। যা, তোর কাজে যা।

এরপর সিংহ তার পথ চলা শুরু করল। যেতে যেতে পেয়ে গেল এক উটকে। মনে মনে ভাবল সম্ভবত মানুষ এটাই। উঠবে তখন ডেকে বলল: দাঁড়া দেখি! তোর নামই কি মানুষ?

উট বলল: খোদা না করুন আমি মানুষ হতে যাব কেন? আমি উট। মরু জঙ্গলের কাঁটা খাই আর বোঝা টানি। আমি নিজেই মানুষের হাতে বন্দী। ওরা আমার পিঠে বোঝা চাপিয়ে দেয়। এরপর ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যদিয়ে পানিবিহীন মরুভূমিতে আমাকে ঘোরায়। তারপরও আমার পায়ে হাতে পায়ে বেড়ি পরায় যাতে পালাতে না পারি।

সিংহ বলল: হ্যাঁ, এসব আমি জানি। শুধু পরীক্ষা করতে এলাম মাথায় আবার মানুষ হওয়ার ভূত চেপেছে কিনা? যা, এখান থেকে সরে যা।

সিংহ আবার পথ চলতে চলতে পেয়ে গেল বড্ড শিংওয়ালা একটি গরুকে। সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল: এই তুই কি মানুষ?

গরু বলল: না জনাব আমি মানুষ নই, আমি গরু। মানুষের হাতে আমি পর্যুদস্ত, নাজেহাল। মানুষেরা আমাদের ধরে নিয়ে গোয়ালে বেঁধে রাখে, দিনের বেলায় জমিনে নিয়ে হাল চাষ করে, আমাদের দিয়েই ফসল মাড়াই করে, দুধ দোহায় এবং শেষতক আমাদের জবাই করে গোশত খায়।

সিংহ বলল: হ্যাঁ এসব আমার আগেই জানা। শুধু জানতে চাইলাম মানুষের সাথে থেকে থেকে মাথায় আবার হঠাৎ করে মানুষ হওয়ার ভুত চেপে গেল কিনা। যা, আমার সামনে থেকে।

সিংহ ভাবতে লাগল: বহুত আজব ব্যাপার! মানুষকে তাহলে সব পশুই ভয় পায়! হাতি, উট, গরু এদের চেয়ে বড় কোনো প্রাণী আছে নাকি! এসব ভাবতে ভাবতে এগুতে লাগল সে। পেয়ে গেল এক ঘোড়াকে। বলল: অ্যাই তুই কেরে? আমি মানুষের খোঁজ করছি।

ঘোড়া বলল: আস্তে, আস্তে কথা বলেন রাজামশাই। মানুষের কানে যাবে কিন্তু। আমাদের কাছেই একজন মানুষ কাজ করছে। ওরা ভীষণ বিপজ্জনক।  

সিংহ: এত কথা না বলে মানুষটা কোথায়- তুই আমাকে তা বল্‌। আমি এক্ষুণি সকল পশুর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব।

সিংহের জোরাজুরিতে ঘোড়া দেখিয়ে দিল লোকটি কোথায় কাজ করছে। সিংহ সেখানে গিয়ে দেখতে পেল- দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে একটি প্রাণি গাছে ডালপালা জমিয়ে একত্রে বাঁধছে এবং তারই মতো আরেকটি বাচ্ছা ছেলে তাকে সাহায্য করছে। সিংহ লোকটিকে জিজ্ঞেস করল: হুম! তোকেই কি মানুষ বলা হয়?

লোকটি হঠাৎ সিং দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল: জি জনাব! আমিই মানুষ।

সিংহ: বেশ, ভালো কথা। আমি জানতে এলাম তুই নাকি পশুদের অত্যাচার করিস?

মানুষ: কি যে বলেন জনাব সিংহ! আমি কোথায় আর অত্যাচার-উৎপীড়ন কোথায়? কে আপনাকে এ ধরনের আজব কথা শোনালো? কেউ যদি আমাদের ভয় পায় তাহলে সে নিজেই ভীতু।

সিংহ: আমি দেখলাম হাতি, গরু, গাধা, ঘোড়া, বানর, শিয়াল এরা সবাই তোর বিরুদ্ধে নালিশ করছে। ওরা তোকে ভয় পায়।

মানুষ: আপনার প্রাণের শপথ! বিশ্বাস করুন ওরা উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। আমরা জোর করে কাউকে ঘাটাই না। তাছাড়া আমাদের সে জোরও নেই। আপনি দেখুন এই দুর্বল শরীর নিয়ে হাতি, বাঘের মতো একটা শক্তিশালী প্রাণীকে কি করে কষ্ট দিতে পারি?  

সিংহ: ঠিকই তো! কথা তো বেশ সুন্দর করে বলতে পারিস।

মানুষ: সুন্দর সুন্দর কথায় বড় কথা নয় জনাব, আসলে আমাদের কাজ-কারবারই সুন্দর। বিশ্বাস করুন, আমরা আমাদের সাধ্যমত যেকোনো কাজই প্রাণীদের জন্য করে যাই। এইতো আজ ভাবতেছিলাম যে, আপনার জন্য সুন্দর একটা ঘর তৈরি করব।  

সিংহ: ঘর, ঘর আবার কি জিনিস?

মানুষ: ঘর কী জিনিস তা বানিয়ে দেখাতে হবে। আপনি কিছুক্ষণ ছায়ার আরাম করুন আমরা একটি ঘর বানিয়ে দিই।

সিংহকে এ কথা বলে লোকটি তার সারগেদকে কাঠ, হাতুড়ি, করাত আর কিছু লোহা আনতে বলল। সবকিছু আনার পর লোকটি তড়িঘড়ি সিংহের জন্য একটা বড় এবং মজবুত খাঁচা তৈরি করে ফেলল। এরপর সিংহকে ডেকে বলল: মহারাজ এই হচ্ছে আপনার ঘর! আপনি যদি চান যে, কেউ আপনাকে বিরক্ত না করুক, তাহলে এর ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখবেন এবং আরামে শুয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবেন।

লোকটির কথাগুলো সিংহের পছন্দ হলো। তাই সে বিনা দ্বিধায় খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়ল। এবার লোকটি তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল। এরপর সাগরেদকে ডেকে আস্তে আস্তে বলল: দেয়ালের ওপাশে আগুন জ্বালা এবং পিতলের বদনাটাতে পানি নিয়ে গরম করতে থাক। যখন ডাকবো তখন বদনাটা নিয়ে আসবি।

এই কথা বলে সে খাঁচার পাশে এসে সিংহের সাথে কথা জুড়ালো এবং বলল: এই যে মানুষ সম্পর্কে লাল্লু পাঞ্জুরা বলে বেড়াচ্ছে মানুষ এই- মানুষ সেই- তা এ কারণে যে, মানুষের শরীরটা ছোটখাটো এবং কোমল হলেও মানুষের মাথা সকল জীবজন্তুর চেয়ে উত্তম কাজ করে। তুই বেটা মানুষকে খুবই তুচ্ছ মনে করেছিস এবং গভীর জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসেছিস যে, মানুষের পিঠের ছাল তুলে নিবি- তাই না? আমাদের বিষ দাঁত, নখ ও থাবা নেই কিন্তু এমন কিছু আছে যা তোদের দাঁত, নখ ও থাবার চেয়েও শতগুণে বিপজ্জনক। এখন আমি একটি ছোট্ট বদনা দিয়ে এমন বালা-মুসিবত তোর মাথায় ঢেলে দেবো যে, যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ভুলবি না এবং আর কোনদিন প্রতিশোধ নেয়ার নামও নিবি না।

এরপর লোকটি মই বেয়ে উঠল খাঁচার উপর এবং সিংহের গায়ে বদনা থেকে ফুটন্ত পানি ঢালতে লাগল।

গরম পানিতে সিংহের সারা গায়ে ফোস্কা পড়ে লোম উঠে গেল, চামড়া লাল দগদগে হয়ে উঠল। তার চিৎকার দেখে কে! খাঁচা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। টিকতে না পেরে যন্ত্রণায় গড়াড়তি করতে করতে সিংহ বলল: আমার যা বোঝার বুঝে গেছি। মানুষ কী চিজ তাও জানলাম। এবার দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও। আর কখনো মানুষের ধারে কাছে আসবে না।

লোকটি বলল: তোকে ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে। জঙ্গলে গিয়ে পশুদের জানাবি যে, মানুষের সাথে যেন জোর দেখাতে না আসে।

সিংহ মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোর পর লোকটা খাঁচা খুলে দিল। দরজার খুলতেই সিংহ প্রাণের ভয়ে দিল ছুট। পিছনে আর ফিরে তাকাল না।

বন্ধুরা, পশুর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে গল্পটি শুনলে। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুকে। 

তো রংধনু আসরে অংশ নেয়ার জন্য আফিফা ইয়াসমিন মারইয়াম তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

 

 

ট্যাগ