জুলাই ১০, ২০২২ ২২:৫৯ Asia/Dhaka

আবারও ফিরে এল পবিত্র ঈদুল আযহা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মহা-আনন্দের আমেজ। এ উৎসব মুসলমানদের অন্যতম প্রধান উৎসব। আদি পিতা আদম (আ)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এটা জারী ছিল।

আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক তরুণ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।

মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানীর ঈদ। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানী।

ঈদুল আযহা খোদার রাহে সর্বোচ্চ ত্যাগের আনন্দের প্রতীক। ঈদুল আযহাকে বলা হয় কুরবানির ঈদ। কিন্তু কুরবানি হতে হবে আন্তরিক। যারা হজব্রত পালন করতে গিয়েছেন তাদের হজ ও পশু কুরবানি কবুল হওয়া নির্ভর করছে খোদাপ্রেমের গভীরতা ও আন্তরিকতার মাত্রার ওপর।  মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর আকর্ষণ ত্যাগ করতে পারা এবং লোভ-লালসাসহ সব ধরনের পশু-প্রবৃত্তিকে কুরবানি করতে পারার মধ্যেই রয়েছে হজ ও পশু কুরবানির সার্থকতা।

ঈদের দিন জামায়াতে নামাজ পড়ার আগেই আমরা মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই এমন এক মহতী উৎসব ও অজস্র নেয়ামত দান করার জন্য।

ইসলামের অনন্য উৎসব ঈদুল আজহা। বিশ্বের মুসলমানরা যে মুসলিম পরিচয় বহন করে। সেই পরিচয়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। তাই এ জাতিকে বলা হয় মিল্লাতে ইবরাহিম বা ইবরাহিমের জাতি। ত্যাগের পরীক্ষায় বহুবার তিনি হয়েছিলেন পরীক্ষিত।

প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর নামে কোরবানি করতে এতটুকুও ছিল না দ্বিধা-সঙ্কোচ। মানুষকে হত্যা করা ছিল না স্রষ্টার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহিমের হৃদয় পরখ করা। উত্তীর্ণ হলেন ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহ পাঠিয়ে ছিলেন দুম্বা। ইসমাইলের (আ.) পরিবর্তে সেই দুম্বা জবাই হয়ে গেল। সেই থেকে অদ্যাবধি চলছে ঈদুল আজহার পশু কুরবানি। কিন্তু এ ঘটনার অন্তর্নিহিত শিক্ষা যে ত্যাগ তা ভুলে গিয়ে আমরাও কি আচারসর্বস্ব হয়ে যাইনি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল তো সেই কথাই বলেছেন তার ‘কুরবানি’ কবিতায়।

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

 দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!

             ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–

আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!

             দুম্বা-শির      রুম্-বাসীর

শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?

             বাস! চুপ খামোশ রোদন!

আজ  শোর ওঠে জোর 'খুন দে, জান দে, শির দে বৎস' শোন!

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। …..

             চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার

মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার।

             'জুল্‌ফেকার' খুল্‌বে তার

দু'ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!

             .....

             কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–

'এয়্‌  ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!'

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।…..

          এই দিনই 'মীনা'-ময়দানে

     পুত্র-স্নেহের গর্দানে

          ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে

 রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!

     ....

          মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে,

খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?

          টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে

ওরে  হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!

     ঢালে    বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন!

ওরে  সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।.....

ঐ   খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!

আজ  আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।–

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের এই কবিতা থেকে এটা স্পষ্ট যে কুরবানি মানে ভোগের জন্য হত্যার উৎসব নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্ম- ত্যাগের বা কুরবাণির শক্তি অর্জনের চেতনা বহন করে এই কুরবানি।  কবি নজরুল তার অন্য এক কবিতায় কুরবানি ঈদের প্রকৃত চেতনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, এই ঈদ এমন বিপ্লবী তরুণ দলের যারা আল্লাহর রাহে নিজেকে ও নিজের সম্পদ কুরবানি করতে পারে, যারা নির্লোভ ও নিরহংকার, নিরভিমান, যারা অবিচার ও জুলুমের বিরোধী ও যারা নির্যাতিতকে মুক্ত করতে চায় নিজের সব কিছু কুরবানি করে। তিনি লিখেছেন:

এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্‌সার,

এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার!

ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী

তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি।

এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা,

ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা!-

আল্লাহর প্রেমে আত্মত্যাগ বা কুরবাণির চেতনায় বিশ্বাসীদের আরও প্রশংসা করে নজরুল লিখেছেন:

প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়,

আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়।
...এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি,

এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি।
ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে,

ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে।
এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি!

কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি!
‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে,

‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে।–

কবি নজরুল আরও লিখেছেন: ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?

আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?

আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি

পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?

সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে,

ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।

অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়,

চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়!

লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত

সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত?

কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে,

আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে।

ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও,

নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও!

নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে,
চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’!

পবিত্র ঈদুল আযহার প্রকৃত মর্ম বা চেতনা তুলে ধরতে গিয়ে জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম আরও লিখেছেন: বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি,
আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি!

পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো,

কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো!
কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ?

এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!

-কবি নজরুলের এ দুই কবিতা পড়ে মনে হয় তিনি যদি বেঁচে থাকতেন ও ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং এর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও জুলুম-নিপীড়ন বিরোধী চরিত্র আর এসবের পাশাপাশি ইরানের বিপ্লবী মুজাহিদ, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও ইয়েমেনের বিপ্লবী মুজাহিদদেরও তিনি দেখতেন, বিশেষ করে শহীদ কাসেম সুলায়মনি ও আবু মাহদি আল মুহানদিস-এর মত বীর শহীদদের দেখতেন তাহলে তার এই কবিতাগুলো তিনি তাদের জন্য উৎসর্গ করে তাদের উদ্দেশে বলতেন (নিজেরই একটি গানের সূত্র ধরে): আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান এরাই তো সেই মুসলমান!  

ঈদুল আযহা ইবরাহীম (আঃ), বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলের পরম ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত উৎসব। ইবরাহীম (আঃ)-কে আল-কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে (হজ্জ ৭৮)। এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের মহত্তম আদর্শ। তাই ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহীমী সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে। কুরবানীর স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। তাঁরা ইবরাহীমী আদর্শে আদর্শবান হতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধেরও এক অনন্য উদাহরণ যা প্রতি বছরই আমাদেরকে তাওহীদী প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। আমরা নিবিড়ভাবে অনুভব করি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। কিন্তু এ ভ্রাতৃত্ববোধ যদি মজলুম ফিলিস্তিনি, রোহিঙ্গা, ইয়েমেনি, কাশ্মিরি, বাহরাইনি, সিরিয় ও আফগান মুসলমানদের কোনো উপকারে না আসে ও মুসলমানদের প্রথম কিবলা এখনও বর্ণবাদী অভিশপ্ত ইহুদিবাদী দখলদারদের দখলে থাকে ও ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীরা এ পবিত্র স্থানের অবমাননা অব্যাহত রাখে তাহলে মুসলিম উম্মাহর কুরবানি ঈদ ও  হজ কি স্বার্থক হবে?

দুঃখজনক বিষয় হল, হজ ও কুরবানির চেতনার বিপরীতে এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার বিপরীতে একদল ধর্মান্ধ মুসলমান পশ্চিমা মদদে নীরিহ মুসলমানদের হত্যা করছে। অন্যদিকে একদল রাজা-বাদশাহ ও প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ইসলামের মহাশত্রু ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সেবায় নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন ও বিকিয়ে দিচ্ছেন জাতীয় সম্মান এবং সম্পদ!

কুরবানীর ঈদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি শুধু কুরবানীর সময়েই গরীব-দুঃখী মানুষকে আহার করিয়ে বছরের বাকি দিনগুলোতে কি তাদের ভুলে থাকব? না, অবশ্যই না। সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগ করতে হবে। এই ত্যাগের মনোভাব যদি গড়ে ওঠে। তবে বুঝতে হবে, কুরবানীর ঈদ স্বার্থক হয়েছে, কুরবানী স্বার্থক হয়েছে। নইলে এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল।

কুরবানির চেতনা স্মরণ করিয়ে দেয় ইমাম হুসাইনের অনন্য আত্মত্যাগের কথা। তিনি কেবল নিজের জীবনই বিসর্জন দেননি ইসলামের জন্য। নিজের পরিবারের প্রায় সব সদস্য ও এমনকি এক বছরের বা মতান্তরে  ছয় মাসের শিশু সন্তানকেও আল্লাহর রাহে কুরবানি করেছেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ হযরত ইব্রাহিমের আত্মত্যাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ইমাম হুসাইন (আ) এটাই শিখিয়ে গেছেন যে ইসলামকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন, পরিবার ও স্ত্রী-কন্যাদের জীবন বিলিয়ে দিতে হবে এবং এমনকি তাদের লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কার বিষয়টিকেও ইসলামের চেয়ে বিন্দুমাত্র প্রাধান্য দেয়া যাবে না।

পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও ঈদ মুবারক।#

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ