মে ০৪, ২০২৪ ১৬:২৭ Asia/Dhaka

১৪৮ হিজরির ২৫ শাওয়াল ইসলামের ইতিহাসে এক গভীর শোকাবহ দিন। কারণ, এই দিনে শাহাদত বরণ করেন মুসলিম বিশ্বের প্রাণপ্রিয় প্রবাদপুরুষ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ জাফর আস সাদিক (আ.)। ইসলাম ও এর প্রকৃত শিক্ষা তাঁর কাছে চিরঋণী। বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদিক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। তিনি ছিলেন আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম। তিনি ছিলেন সব ধরনের জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের অন্যতম এবং ইসলামের অন্যতম সেরা ফকিহ ও আইনবিদ

যাদের অক্লান্ত শ্রম,জ্ঞান-সাধনা ও রক্তের ফসল আজ এই পবিত্র ইসলাম 
মহান আল্লাহর আরশে-আযমে খোদাই যাঁদের পবিত্র নাম
যাদের নুরের ঔজ্জ্বল্যে উজালা হল স্বর্গ-মর্ত ধাম 
সভ্যতার ঝলমলে সোনালী দিন আনলো যাদের প্রজ্ঞা-প্রদীপ্ত কালাম 
যাদের আসমানি উদারতা আর স্বর্গীয় মহত্ত্বের সুবাস পেয়ে ধন্য খাস ও আম 
যাদের আলোক-প্রভার পরশ পেতে উন্মুখ আম্বিয়ায়ে কেরাম 
তাঁদের তরে ঝরে পড়ুক অজস্র দরুদ ও সালাম
ইসলামী সভ্যতার এমনই এক অনন্য নকীব বিশ্ব-বিশ্রুত মহান ইমাম
মহানবীর (সা) রহমত-তরীর নির্ভীক কর্ণধার জাফর আস সাদিক আল-ইমাম!!

রেখেছেন চির-উন্নত নবী-বংশের সুনাম ও মুহাম্মাদি পয়গাম !
জ্ঞানের সব শাখা-আলোকিত-করা ইসলামের চির-গৌরবময় আলাম!
মর্মান্তিক শাহাদাত যার আজও তোলে মর্মভেদী শোকের তুফান-উদ্দাম!


হযরত ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ আস সাদিক বিন ইমাম বাকির (আ.) হিজরি ৮৩ সনের ১৭ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরি ১৪৮ সনের ২৫ শাওয়াল আব্বাসীয় শাসক মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন। তাঁকে মদিনার জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রূপকার ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদিক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। তিনি ছিলেন আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম।  তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মে ফারওয়াহ ফাতিমা। তাঁর যুগে তদানীন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান বেশ কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ঘটে এবং এসবের ফলে কথিত উমাইয়া খেলাফত বা রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।

মহানবীর আহলে বাইতের ধারায় পঞ্চম ইমাম তথা ইমাম জাফর আস সাদিকের পিতা হযরত বাকির (আ.) তাঁর দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামত কালে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃঙ্খল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন। এভাবে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  পিতার শাহাদতের পর ৩১ বছর বয়সে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) মুসলিম জাহানের ইমামতি বা নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন।  তিনি ১১৪ হিজরি থেকে ১৪৮ হিজরি পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর হেদায়াতের দায়িত্ব পালন করেন।

ইমাম জাফর আস সাদিকের ইমামতের যুগটি ছিল কথিত উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ। ইমাম ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটান। ইসলামী ইতিহাসের বিপুল সংখ্যক বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামী শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ আলেম তাঁর কাছেই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ, মুহাম্মদ বিন মুসলিম, মুমিন তাক, হিশাম বিন হাকাম, আবান বিন তাগলুব, হিশাম বিন সালিম, হারিয, হিশাম কালবী নাসাবাহ ও রসায়ন শাস্ত্রের জনক নামে খ্যাত জাবির বিন হাইয়্যান সুফীর নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের বিপুল সংখ্যক বিখ্যাত আলেমও তাঁর ছাত্র হয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এদের মধ্যে হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা,সুফিয়ান সাওরী,কাযী সাকুনী,কাযী আব্দুল বাখতারী,প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদিস বিশারদ) ও ইসলামী পণ্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য। হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বর্ণিত ইসলামী বর্ণনার সংখ্যা মহানবীর-সা. ও তাঁর আহলে বাইতের অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদিসের চেয়েও অনেক বেশী।

কিন্তু হযরত জাফর সাদিক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় শাসক মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন। মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা,নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করে। মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন। তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া রাজাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানায়। মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত। অন্ধকারাচ্ছন্ন জেলে তাদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত। তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে ও বহুজনকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে। তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্টালিকা নির্মাণ করা হত।

আব্বাসিয় শাসক মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে মদিনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে। অবশ্য হযরত ইমাম সাদিক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফফাহ'র -র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর পিতার (পঞ্চম ইমাম বাকের আ.) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাঁকে উপস্থিত হতে হয়েছিল। মানসুর বেশ কিছুকাল ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখে ও বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল। অবশেষে সে ইমামকে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলে ইমাম মদিনায় ফিরে যান। ইমাম তাঁর জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন ‘তাকিয়া ’ বা গোপনীয়তা বজায় রেখে অতিবাহিত করেন। তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগ-বিহীন ঘরকুনো জীবন যাপন শুরু করেন। এরপর এক সময় মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয়।

আব্বাসিয় শাসক মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদিনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠায়। ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে,মদিনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্ত্বনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায়। অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা’(উইল) তাঁর পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে। ইমামের‘ওসিয়ত নামায়’ যাকে তাঁর পরবর্তী ইমাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয়। এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া। কেননা এর ফলে আহলেবাইতপন্থী মুসলমান তথা শিয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে। মানসুরের নির্দেশ অনুসারে মদিনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর‘ওসিয়ত নামা’ চেয়ে নেয়। কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কারণ,ঐ‘ওসিয়ত নামায়’ ইমাম মানসুর ও মদিনার প্রশাসক এবং নিজের দুই সন্তানসহ পাঁচ ব্যক্তিকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন। -

ইমাম সাদিক (আ.) নিজ দাদা ও বনি হাশিমের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ইমাম আলী ইবনে হুসাইন জাইনুল আবেদীন (আ.) এবং পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.)-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হন। তিনি বারো বছর ধরে (অন্যান্য বর্ণনামতে ১৫ বছর বা  ১৬ বছর) দাদার সান্নিধ্য এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সাদিক (আ.) নিজ পিতা ইমাম বাকির (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে উনিশ বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর ইমামতের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) যে মহাসাগরের মত অগাধ জ্ঞানের অধিকারী  ছিলেন তা ছিল নবুওতী জ্ঞানেরই উত্তরাধিকার। আর এ ধরনের জ্ঞান আল্লাহর অতি নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য ব্যক্তিদের পক্ষে অর্জন অকল্পনীয় বা অসম্ভব। আর এ জন্যেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলতেন, “আমার বক্তব্য আমার পিতা তথা ইমাম বাকের (আ.)'র বক্তব্য, আমার পিতার বক্তব্য আমার দাদা তথা ইমাম জাইনুল আবেদীন (আ.)'র বক্তব্য,আমার দাদার বক্তব্য হচ্ছে  আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)'র বক্তব্য এবং তাঁর বক্তব্য হচ্ছে রাসূল (সা.)'রই বক্তব্য, আর রাসূলে খোদা (সা.)'র বক্তব্য হচ্ছে মহান আল্লাহরই বক্তব্য। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছিলেন, আমাদের তথা রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের কাছে রয়েছে ভবিষ্যতের জ্ঞান, অতীতের জ্ঞান, অন্তরে অনুপ্রাণিত বা সঞ্চারিত জ্ঞান, ফেরেশতাদের বাণী যা আমরা শুনতে পাই, আমাদের কাছে রয়েছে রাসূল (সা.)'র অস্ত্রসমূহ এবং আহলে বাইতের সদস্য ইমাম মাহদী (আ.)'র কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত সেগুলো আমাদের হাতছাড়া হবে না। আমাদের কাছে রয়েছে হযরত মূসা (আ.)'র তৌরাত, হযরত ঈসা (আ.)'র ইঞ্জিল, হযরত দাউদ (আ.)'র যাবুর এবং মহান আল্লাহর পাঠানো অন্যান্য আসমানি কেতাব।” তিনি আরো বলেছেন, “এ ছাড়াও আমাদের কাছে রয়েছে হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)'র সহিফা যাতে রয়েছে সমস্ত ভবিষ্যৎ ঘটনার বিবরণ এবং পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত সমস্ত শাসকের নাম তাতে লেখা আছে। আমাদের কাছে রয়েছে আল জামী নামের দলীল, সত্তুর গজ দীর্ঘ ঐ দলীলে লেখা রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.)'র  নিজ মুখের  উচ্চারিত ও নির্দেশিত বাণী এবং ঐসব বাণী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) নিজ হাতে লিখেছিলেন। আল্লাহর শপথ! এতে রয়েছে মানুষের জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু।”

অনন্য চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী ইমাম সাদিক (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও মহাজ্ঞানী। তাঁর পিতার শাহাদতের পর মুসলিম জাহানে তিনিই ছিলেন জ্ঞানের সবচেয়ে বড় উৎস বা পরশমণি। আলোর প্রতি কীট-পতঙ্গের আকর্ষণ যেমন দুনির্বার তেমনি তাঁর জ্ঞান ও শিক্ষা-আন্দোলনের অনিবার্য নূরানি আকর্ষণ আকৃষ্ট করেছিল সেযুগের অধিকাংশ জ্ঞান-পিপাসু এবং পণ্ডিতকে। এক্ষেত্রে উমাইয়া বা আব্বাসীয় শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বাধাও বাঁধ-ভাঙ্গা জোয়ারের মধ্যে বালির বাঁধের মতোই ভেসে গেছে। হাদিস শাস্ত্রের ক্ষেত্রে বলা হয় ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র কাছ থেকে চার হাজার রাবী হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন। ইমাম তাঁর ছাত্রদেরকে ফিকাহ, হাদিস ও তাফসীর ছাড়াও অংক ও রসায়ন শাস্ত্রের মতো বিভিন্ন বিজ্ঞানও শিক্ষা দিতেন।
বিখ্যাত ফকিহ মুহাম্মাদ বিন মুসলিম ও যুরারেহ, বিখ্যাত কালাম শাস্ত্রবিদ ও দার্শনিক হিশাম, ইরফান ও আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের বিশিষ্ট পণ্ডিত মুফায্যাল ও সাফাওয়ান এবং অংক ও রসায়ন শাস্ত্রের জগত-বিখ্যাত পণ্ডিত জাবির ইবনে হাইয়ানের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ইমাম জাফর সাদিক (আ.) 'র জ্ঞানের অমিয় ধারার স্পর্শে। এছাড়াও বায়েজীদ বোস্তামী, হাসান বসরী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের মতো বিশ্ববিশ্রুত মনীষীরা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে নিজেদের ধন্য করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম ইমাম আবু হানিফা দুই বছর ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র ছাত্র ছিলেন। 

সুন্নি মাজহাবের প্রধান ইমাম আবু হানিফা ছাড়াও ইমাম মালিক  ছিলেন এই নিষ্পাপ ইমামের প্রত্যক্ষ ছাত্র। আর সুন্নি মাজহাবের অন্য দুই ইমাম ছিলেন ইমাম জাফর সাদিকের ছাত্রের ছাত্র তথা পরোক্ষ ছাত্র। আহলে সুন্নাতের মালিকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা মালিক ইবনে আনাস বলেছেন. "এক সময় আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের কাছে যাওয়া-আসা করতাম। যখনই আমি তাঁর সাক্ষাতে যেতাম তখন আমি তাকে এ তিন অবস্থার যে কোন এক অবস্থায় পেতাম,হয় তিনি নামাজ পড়ছেন অথবা রোজা রেখেছেন অথবা কুরআন তিলাওয়াত করছেন। জ্ঞান, ইবাদত ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে কোনো চোখই দেখেনি, কোনো কানই শোনেনি এবং কোনো মানুষই কল্পনা করেনি।" মালিক ইমামের কাছ থেকে হাদিসও বর্ণনা করেছেন। 

আহলে সুন্নাতের হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা বলেছেন, "আমি জাফর ইবেন মুহাম্মাদ থেকে বড় কোন জ্ঞানী বা ফকিহকে দেখিনি। সবচেয়ে জ্ঞানী হল সেই ব্যক্তি যে মানুষের মধ্যে মতপার্থক্যের বিষয়গুলো সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। আর জাফর ইবেন মুহাম্মাদ হলেন সেই জ্ঞানের অধিকারী। অতীত যুগে আরবি ভাষায় ফিক্‌হ বা ফিকাহ বলতে সব ধরনের জ্ঞানকে বোঝানো হত। 

ইমাম আবু হানিফা ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে  আবু হানিফা বলেছেন, যদি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের সান্নিধ্যের তথা ক্লাসের ঐ দু’বছর না থাকত তবে নোমান তথা আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত। আবু হানিফা বলতেন, সেই দুই বছরে আমি যা শিখেছি সারা জীবনেও আমি ততটা শিখতে পারিনি। 

প্রখ্যাত সুন্নি মনীষী ইবনে হাজার আসকালানি এই মহান ইমাম সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি জিকর, নামাজ, ইবাদাত ও তাহাজ্জুদে এতটা কঠোরভাবে মশগুল থাকতেন যে, যদি এক্ষেত্রে আকাশমণ্ডলীও তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হত তবে তার স্থানচ্যুতি (ধৈর্যচ্যুতি) ঘটতো।’

সাইয়্যেদ মির আলী হিন্দি এই মহান ইমাম সম্পর্কে (তারিখুল আরাব বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠা) বলেছেন, 'তিনি দিগন্ত প্রসারী চিন্তাশক্তি ও দূর-দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর যুগে প্রচলিত জ্ঞানসমূহের সকল শাখায় পূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রসিদ্ধ অর্থে ইসলামে দর্শন শিক্ষার গোড়া পত্তন করেন। যারা ইসলামে ফিকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন কেবল তারাই তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেননি বরং দর্শন শিক্ষার্থী ও দার্শনিকরাও ইসলামী বিশ্বের দূর দূরান্ত থেকে তাঁর ক্লাসে উপস্থিত হতেন।’ 
ইমাম জাফর আস সাদিকের ক্লাসে দুই থেকে চার হাজার ছাত্র উপস্থিত হতেন। প্রখ্যাত সুন্নি ইমামরাসহ চার হাজার ব্যক্তি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।  

ইসলামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও এ ধর্মকে সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত হামলাসহ সার্বিক ক্ষতিকর দিক থেকে সুরক্ষার জন্য যা যা করার দরকার তার সবই তিনি করেছিলেন।  ৩৪ বছর ধরে মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৪৮ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল শাহাদত বরণ করেন ইমাম জাফর সাদিক (আ)। আব্বাসিয় শাসক মানসুর দাওয়ানিকি বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে।

নবী-রাসূলদেরকে যেমন অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়ে,  তেমনি তাদের উত্তরসূরি মহান ইমামদেরকেও একই অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল আব্বাসিয় জালিম শাসক মনসুর দাওয়ানিকি। দাওয়ানিকি বলেছিল:

 "জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছে না, কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।"
দাওয়ানিকির নির্দেশে ইসলামের চির-প্রদীপ্ত সূর্য ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)কে শহীদ করা হলেও  শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বহুগুণ বেড়ে যায়। ৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন:

'তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতে? তাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতাম, কাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ।'

ইমামের সামনে বিশ্বনবী  হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। হজের ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করতেন।

আরো একবার গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে এবং ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কিছু অমূল্য উপদেশ-বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা:
তিনি বলেছেন, যারা নামাজকে কম গুরুত্ব দেবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’ বলেছেন, কোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারা, সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।
তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়, যুদ্ধের সময় বীরত্বের পরিচয় ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।#

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ