হযরত ইমাম হাসান (আ)'র শাহাদত বার্ষিকী
(last modified Thu, 15 Oct 2020 10:30:00 GMT )
অক্টোবর ১৫, ২০২০ ১৬:৩০ Asia/Dhaka

দশম হিজরির ২৮ সফর দুনিয়া থেকে বিদায় নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং চল্লিশ বছর পর ৫০ হিজরির একই দিনে শাহাদত বরণ করেন তাঁরই প্রথম নাতি হযরত ইমাম হাসান (আ)।

ইমাম হাসান জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তৃতীয় হিজরির ১৫  রমজানে।  ইমাম হাসান (আ.)'র সাত বছর বয়স পর্যন্ত মহানবী (সা.) বেঁচে ছিলেন। রাসূল (সা.) বহুবার প্রিয় এই নাতিকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, “হে প্রভু, আমি ওকে ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন। “তিনি আরও বলতেন, “যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসল। আর যারা এ দুজনের সঙ্গে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করল।”বিশ্বনবী (সা.) হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে “বেহেশতের যুবকদের নেতা”ও “মুসলিম উম্মাহর দুই সুবাসিত ফুল”বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি আরও বলেছেন, “আমার এই দুই নাতি উভয়ই মুসলমানদের ইমাম বা নেতা, তা তারা তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক বা না দাঁড়াক।” বিশ্বনবী (সা.) এই দুই নাতির শৈশবে তাঁদের সঙ্গে খেলতেন, তাদের বুকে চেপে ধরতেন, চুমু খেতেন এবং তাদের ঘ্রাণ নিতেন। তাঁরা মহানবীর নামাজের সময় নানার গলায় বসে পড়লে নানা সিজদা থেকে উঠতেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই উঠে যেতেন। মহানবী ইমাম হাসান ও হুসাইনকে তাঁদের শৈশবেই অনেক চুক্তিপত্রের সাক্ষী করেছেন। 

ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর নানা ও পিতার অনুসারী এবং তিনি তাঁদের মতই অত্যাচারীদের সমালোচনা করতেন ও মজলুমদের সমর্থন দিতেন। তিনি জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে পিতার পক্ষে অংশ নিয়ে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) নিজের ইন্তিকালের সময় ইমাম হাসান (আ.)-কে তার খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। বিশ্বনবীই তা করার জন্য ইমাম আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের জীবদ্দশায়। 
ইমাম হাসান (আ.) যখন ওজু করতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি কাঁপতে থাকতেন। মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা যখন স্মরণ করতেন তখন তিনি কাঁদতেন ও বেহাল হয়ে পড়তেন। তিনি পায়ে হেঁটে এবং কখনও নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ করেছেন। ইমাম হাসান (আ.) জীবনে অন্ততঃ দুবার তাঁর ব্যক্তিগত সব সম্পদ দান করে দিয়েছেন এবং বেশ কয়েকবার অর্ধেক বা তারও বেশি সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন। মানুষের সমস্যা সমাধানে তিনি এত উদগ্রীব ও ব্যস্ত থাকতেন যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের কথা তাঁর জানা ছিল না। ইমাম হাসানের (আ.)’র ক্ষমাশীলতা, পরোপোকারিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা শত্রুদেরও মুগ্ধ করত। 

ইমাম হাসান (আ.) খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তা মেনে নেয়নি। আলী (আ.)'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রের যে ধারা মুয়াবিয়া চালু করেছিল এই নতুন ইমামের বিরুদ্ধেও সেই একই ধারা অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় ইমাম হাসানও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন ও যুদ্ধের প্রথম দিকে সাফল্যও লাভ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার নানা চক্রান্তের মুখে একদল সহযোগীর বিশ্বাসঘাতকতা ও জনগণের ধৈর্যহীনতার কারণে ইমাম শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। ইমাম বেশ কিছু কঠিন শর্ত দিয়ে সন্ধি-চুক্তি করেন। উল্লেখ্য, বিদ্রোহী মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই যোদ্ধাদের বেতন শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেছিলেন।  ইমাম হাসান (আ.) এও জানতেন যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা বা শাসন-ক্ষমতা হাতে না পেলেও  মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত  ইমামই থেকে যাবেন। তাই মুয়াবিয়ার আসল চেহারা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য তাকে কিছু (নোংরা কাজের সুযোগ) অবকাশ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে এ সন্ধির ফলে মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।  মুয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত সন্ধি-চুক্তির অপব্যবহার করেছিল যদিও   ইমাম সন্ধির শর্তেই এটা উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলবেন না। এরই আলোকে তিনি কখনও মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়্যাত হননি এবং মুয়াবিয়ার কোনো নির্দেশই মান্য করতেন না। আসলে সন্ধির মাধ্যমে ইমাম হাসান কারবালা বিপ্লবের পটভূমিই গড়ে তুলেছিলেন। 

যেমন, মুয়াবিয়া খারেজিদের বিদ্রোহ দমনে ইমামের সহায়তা চান এবং তাঁকে খারিজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমাম হাসান (আ.) তাঁর কথায় মোটেও কর্ণপাত করেননি। বরং তাকে জানিয়ে দেন যে যুদ্ধ যদি করতে হয় তবে তোমার সঙ্গেই যুদ্ধ করব! 

উল্লেখ্য, ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থেকে থাকলেও  তা নিছক পরিবেশ ও পরিস্থিতির দাবিতেই হয়, কখনও তা তাদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য থেকে উদ্ভুত হয় না।  মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের (আ.) সঙ্গে সন্ধির পর যখন সব কিছুর ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তখন সে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করবে বলে জানিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া নিজের মৃত্যু আসন্ন এটা উপলব্ধি করতে পেরে ছেলে ইয়াজিদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে থাকে। সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, ইমাম হাসান (আ.) বেঁচে থাকলে জনগণ সহজেই তার লম্পট ছেলেকে খলিফা হতে দেবে না। তাই মুয়াবিয়া বেশ কয়েকবার ইমামকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করে। অবশেষ চক্রান্তের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমামকে শহীদ করে। মুয়াবিয়া অত্যন্ত কূট-কৌশলে ইমামের (আ.) এক স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে তাঁকে দিয়ে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করতে সক্ষম হয়।  পঞ্চাশ হিজরির সফর মাসের ২৮ তারিখে ৪৭ বা ৪৮ বছর বয়সে শাহাদতের অমৃত পান করেন ইমাম হাসান (আ.)। 
ইমাম হাসান (আ.) দেখতে প্রায় নানার মত তথা বিশ্বনবী (সা.)’র মত ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণও ছিল সে রকম। তাঁকে দেখলেই রাসূল (সা.)’র স্মৃতি চাঙ্গা হত দর্শকদের মনে।  সবাইকে আবারও গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ