'শিক্ষার্থীদের মেধার যাচাই হওয়া জরুরি, প্রয়োজন বিকল্প পদ্ধতির'
লটারি পদ্ধতিতে স্কুলে ভর্তি: অভিভাবক শিক্ষকসহ বিশ্লেষকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সব স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়ায় লটারি পদ্ধতি চালু হয়েছে ২০২০ সাল থেকে। শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমাতে এবং তদবির বন্ধে এই সিদ্ধান্ত। যদিও আগে বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে লটারি ও অন্যান্য শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। এতে মেধা যাচাই করার সুযোগ ছিল। দেশের মহানগর পর্যায়ের পরে ২০২১ সাল থেকে জেলা পর্যায়েও চালু হয় লটারি পদ্ধতি।
এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা রয়েছে। তবু একেবারে ছোট শিশুদের জন্য লটারিতে ভর্তি অনেকটা সঠিক বলে মনে করছেন কেউ কেউ। কারণ ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য তাদের ওপর অনেক চাপ দিতেন অভিভাবকরা। ভর্তির ক্ষেত্রে চলত ভর্তিযুদ্ধ। এ রকম যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য 'লটারি ভালো' বলে আখ্যাও দিয়েছেন অনেকে। তবে লটারি কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়ায় পদ্ধতিটি নিয়ে আবারো আলোচনা তুঙ্গে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ২০২৩ সালের ভর্তি লটারিতে অনেক শিক্ষার্থীর নাম ৬-১০ বার আসার অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
প্রকাশিত ফলাফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গভ. মডেল গার্লস হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তির ফলাফলে তাহিয়া নামের এক শিক্ষার্থীর নাম ১৪ বার উঠেছে। এর মধ্যে মেধা তালিকায় ১০ বার ও অপেক্ষমাণ তালিকায় চারবার তার নাম রয়েছে। একইভাবে ফারিয়া জামান জেসি ও ফারিয়া আরফা নামে এক শিক্ষার্থীর নাম পাঁচবার উঠে। একই ছবি ও জন্মনিবন্ধন নম্বরে ফারিয়া জামান জেসি ও ফারিয়া আরফা নামে পৃথক নাম রয়েছে তালিকায়। এ ধরণের ‘অদ্ভুত’ ফলাফলে নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এমন বাস্তবতায় লটারিতে ভর্তির পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন সঠিক প্রক্রিয়া, কেউবা বলছেন মেধা নষ্টের কথা। ভালো স্কুলগুলো লটারির কারণে তাদের গৌরব হারানোর শঙ্কায় পড়েছে। লটারির কারণে অনেক ভালো ছাত্রছাত্রী নামকরা স্কুলে ভর্তি হতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ছে। অনেকে আবার কোনো স্কুলেই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। যদিও সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বলা হচ্ছে, লটারি পদ্ধতি চালু হওয়ায় বৈষম্য দূর ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে।
এ বিষয়ে ঢাকার আজিমপুরের এক অভিভাবক নার্গিস মুন্নী রেডিও তেহরানকে বলেন, বাচ্চাকে সারা বছর বিভিন্ন বিষয়ে পড়িয়ে প্রস্তুত করেও দেখলাম এবারও ভর্তি পরীক্ষা না হয়ে লটারি হল। তবে ভাগ্যের পরীক্ষায় ছেলের চান্স হয়নি। তবে পরীক্ষা হলে তার ছেলে চান্স পেত বলে মনে করেন তিনি।
আরেক অভিভাবক বাংলাদেশের জেলাশহর শরিয়তপুরের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রোমান বাদশাহ রেডিও তেহরানকে বলেন, তার মেয়ে দুর্ভাগ্যবশত ঢাকার একটি নামকরা স্কুলের ভর্তি ফরম জমা দিয়েও লটারিতে চান্স পায়নি। তিনি মনে করেন লটারির ফলে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ কমে আসছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলাকাভিত্তিক ক্যাচমেন্ট এরিয়ার সুযোগটাকেও সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন ডা. রোমান।
এদিকে, টঙ্গীর হাজী সাইদ ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আতিক রেডিও তেহরানকে বলেছেন, লটারির কারণে কেউ হয়তো ভর্তির সুযোগ পেয়েছে; কিন্তু সরকারি স্কুল দূরে থাক, গ্রামের বাইরে তথা শহরে সে ভর্তি হতে পারছে না আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে। এমনও হতে পারে, ভর্তি হওয়ার পর শহরে থাকা-খাওয়া তার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। ন্যূনতমসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ দিতে দেশের সরকারি স্কুলের অর্ধেকাংশে ভর্তি পরীক্ষা চালু করা যেতে পারে বলে মনে করেন সৈয়দ আতিক। কেননা, শিক্ষার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত রাখার সুযোগ নেই। সমন্বিত ও বাস্তব অবস্থার নিরিখে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের এ ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে রেডিও তেহরানের সঙ্গে কথা বলেছেন, কানাডার টরেন্টো প্রবাসী দৈনিক নতুন দেশ সম্পাদক সওগাত আলী সাগরের সঙ্গে। তিনি বলেন, লটারি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এরফলে শিক্ষার্থীর মেধার যাচাই কোনভাবেই সম্ভব না। শিক্ষার্থী অদৃষ্টবাদিতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, বাস্তবতাকে এড়িয়ে। তাই এলাকাভিত্তিক স্কুল ভর্তি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নেয়া এখন জরুরি বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক।#
পার্সটুডে/নিলয় রহমান/আশরাফুর রহমান/১৯