‘ভাষা নিয়ে আসে সংহতি ও মুক্তির স্বাদ, প্রাণে জাগায় প্রেরণা’
(last modified Mon, 22 Feb 2021 07:33:10 GMT )
ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১ ১৩:৩৩ Asia/Dhaka
  • ‘ভাষা নিয়ে আসে সংহতি ও মুক্তির স্বাদ, প্রাণে জাগায় প্রেরণা’

মাতৃভাষায় আমাদের সৃষ্টি শক্তি, কল্পনাশক্তি পুষ্টি লাভ করে। তাই মাতৃভাষা আমাদের কাছে মাতৃদুগ্ধ সম। মাতৃভাষাতেই আমরা একটু একটু করে এগোই পূর্ণতার দিকে। আমরা মিশে যেতে থাকি মাতৃভাষার গভীরে।

যে ভাষাতে শিশুর সঙ্গে মায়ের আত্মিক যোগ ঘটে, যে ভাষা শুনে আমরা হই আচ্ছন্ন, সেই ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল ব্যাপক আন্দোলন। বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। মাতৃভাষা প্রেমী সকল মানুষের কাছেই এই দিনটি হলো শপথের, সংগ্রামী এবং স্বীকৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক।

রফিক, সালাম, বরকতের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই বাংলার কবি গেয়ে ওঠেন- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি?' আমরা ভুলিনি একদিনের জন্যও। তাই প্রতিবছর এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন করে। ভারত বর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে জন্ম নিয়েছিল নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। একদিকে পূর্ব পাকিস্তান অবিভক্ত বঙ্গ ভূমির পূর্বদিকের শতকরা ৬২ ভাগ নিয়ে গঠিত হয় এই পাকিস্তান। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বড় হলেও পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল বেশি এবং শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী। তাই দেশ বিভাগের পূর্বে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ 'বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত' বলে দাবি জানান।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে ঘোষণা করা হয় ১৯৪৬ সালে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী রাষ্ট্রপ্রধান ইচ্ছানুসারে পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীগণ প্রথম থেকে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পুলিশ ওদের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত স্তরের বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং উর্দুর সঙ্গে বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। মাতৃভাষা বাংলাকে পদদলিত করে উর্দু ভাষাকে মেনে নিতে রাজি হননি কেউই। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নিলেন না। তারা বাঙালি, বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করে দিলেন। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জানিয়ে দেন 'বাংলা নয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। এতে দেখা যায় তীব্র আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা নীতির বিরুদ্ধে ডাক দেওয়া হয় সর্বাত্মক ধর্মঘটের।

তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মন্ত্রীর হুকুমে সেই মিছিলে গুলি চালানো হয়। বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার, শফিউর প্রভৃতি যুবকরা রক্তাক্ত হয়ে প্রাণ হারান। শুরু হয়ে যায় তীব্র আন্দোলন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ শহীদের রক্তে রাঙা হয়ে গেল। জীবনের বিনিময়ে ভাষা মুক্তির এই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণ রাখতে বাংলাভাষীরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। ২০০০ সালে রাষ্ট্রসংঘ ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

২১ ফেব্রুয়ারি দিবসটিকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ তার মাতৃভাষায় সাবলীল, অনায়াসে সে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে, যা অন্য ভাষায় তার পক্ষে সম্ভব হলেও আন্তরিক হয়ে ওঠে না। তাছাড়া মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার অর্জন করতে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল বর্তমানে তা তাৎপর্যমণ্ডিত। আমরা প্রত্যেকেই মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল। আপন ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সকল মানুষের। এখানেই নিহিত রয়েছে এই দিবসটি পালনের গুরুত্ব।

পৃথিবীর মাত্র একটি মাত্র ভাষা, যে ভাষাতে রচিত হয়েছে দুই দেশের জাতীয় সংগীত। রাজনৈতিকভাবে দুটি দেশ আজ বিভক্ত। কিন্তু রয়ে গেছি হৃদয়ের টান, আত্মিক যোগ। বাংলা ভাষার জগতে আমরা মুগ্ধ হই। তাই ওপার বাংলার সাথে এপার বাংলায় দিনটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। মহাসমারোহে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। দীর্ঘ পাঁচ দশক পরেও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে রক্ত ঝরানো সেই দিনটি, বাঙালির মননে।

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ভাষা নিয়ে আসে সংহতি। প্রাণে জাগায় প্রেরণা, নিয়ে আসে মুক্তির স্বাদ।

দায়মুক্তির আর এক নাম, স্বাধীনতার আর এক নাম ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে প্রাণের জোয়ার, জাগিয়ে তোলে মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ববোধ। বাংলা ভাষাতেই রচিত হয় প্রাণের গান, প্রাণের সুর, প্রেরণা জোগায় জীবনের। পথিক ক্লান্তি ভোলে, লাবিক অথৈ সাগরে কূল খুঁজে পায় এই ভাষাতেই। আমাদের শেষ আশ্রয় বাংলা ভাষা। 'বিনা স্বদেশী ভাষা/ মিটে কি প্রাণের আশা?' তাই কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়- 'মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!'

 

ধন্যবাদান্তে

বিধান চন্দ্র সান্যাল

ঢাকা কলোনী, বালুরঘাট

দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।