এপ্রিল ০৭, ২০২৪ ১৩:৫৫ Asia/Dhaka

ফার্সিতে বইটির নাম 'বগহয়ে মুয়াল্লাক্ব'। বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'ঝুলন্ত বাগানগুলো'। সিরিয়ার এক অবরুদ্ধ শহরের সাত নারীর দুর্বিসহ অভিজ্ঞতা অবলম্বনে বইটি লিখেছেন ইরানের বিখ্যাত লেখিকা সুমাইয়া অলামি। সিরিয়ার 'নাবাল ওয়া আযযাহরা' শহরটি দীর্ঘ চার বছর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে অবরুদ্ধ ছিল। সেই শহরেরই বাসিন্দা ঐ সাত নারী।

বর্তমানে ইরানে সাহিত্য অঙ্গনে যাদের নিয়মিত পদচারণা তাদের কাছে পরিচিত নাম সুমাইয়া অলামি। ১৯৭৯ সালে তাঁর জন্ম। পড়াশোনা করেছেন ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বায়োটেকনোলজি নিয়েও পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু লেখালেখিতেই উৎসাহবোধ করলেন বেশি। তাই বায়োটেকনোলজির পাঠ না চুকিয়েই মনোযোগ দিলেন লেখালেখিতে। এখন তিনি পুরাদস্তুর একজন কথাসাহিত্যিক। এরিমধ্যে বেশ কিছু উপন্যাস ও গল্পের বই বেরিয়েছে, বইগুলো সুনামও কুড়িয়েছে বেশ।

এক বছর সিরিয়ায় অবস্থান করেছেন এই লেখিকা। কোনো ঘটনার বর্ণনায় যে বিষয়গুলো ওঠে আসা উচিৎ তা নিয়ে সিরিয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিতেন সুমাইয়া অলামি। তার কর্মশালাগুলোতে অনেক নারী অংশ নিতেন। এসব কর্মশালায় অংশ নেয়া নারীদের নানা বর্ণনাই তাঁর বইয়ের উপজীব্য। অবরুদ্ধ শহরের সাত নারীর চার বছরের জীবন কাহিনী নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এই লেখিকা।

'ঝুলন্ত বাগানগুলো' লেখার চিন্তা কীভাবে এলো, এমন প্রশ্নের উত্তরে সুমাইয়া অলামি বলেছেন, 'শহর ও যুদ্ধের সাথে একজন নারীর সম্পর্ক এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর ভূমিকা নিয়ে আমি সব সময় চিন্তা-ভাবনা করি। আদর্শ সমাজ তথা ইউটোপিয়ায় একজন নারীর অবস্থান কোথায় তা খোঁজার চেষ্টা করতাম প্রতিনিয়ত। পশ্চিমা ইউটোপিয়াতে আমি কেবল ফেমিনিজমের উপাদানগুলোই খুঁজে পেয়েছি, যা আমার মতে পুঁজিবাদের একটি সাংস্কৃতিক সংযুক্তি মাত্র। মানব পুঁজির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।'

বইটি লেখার ক্ষেত্রে লেখিকার শৈশবের অভিজ্ঞতার প্রভাব রয়েছে। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার শৈশব কেটেছে ইরান ও ইরাকের তৎকালীন বাথ সরকারের মধ্যে যুদ্ধের মাঝে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমার বাবা-মা একের পর এক সফর করতে বাধ্য হয়েছেন। আমিও তাদের সঙ্গে সফর করেছি। আমার মা যুদ্ধে সহযোগিতা প্রদান সংক্রান্ত দপ্তরে সক্রিয় ছিলেন এবং আমি তাঁকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিতে দেখেছি, ব্যবস্থাপনায় তাঁর ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেছি।  এর ভিত্তিতে আমার মনে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার একটা মডেল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'কেউ মুখ ফুটে না বললেও আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, নারী এবং একটি দেশের পতনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যখন দামেস্কে প্রবেশ করি, তখনি আমি সিরিয়ার যুদ্ধে নারীদের অবস্থা ও ভূমিকা নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।'

তিনি 'ঝুলন্ত বাগানগুলো' বইটির নামকরণ সম্পর্কে বলেছেন, 'বাগান হলো এমন একটি জায়গা যেখানে গাছ থাকে। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় গাছের শেকড়ের পরিমাণ বেশি থাকে এবং সাইজেই সেগুলো হয় বড়। এই শেকড়গুলো গাছকে মাটির উপর দাঁড় করিয়ে রাখে এবং মাটির ক্ষুদ্র দানাগুলোকে একত্রে আটকে রাখে। নারীর ভূমিকাও বাগানের গাছের মতো। নারীরাই একটি ভূখণ্ডের জন্ম ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন। তারা ঘর সামলান। অবশ্যই এই নামের সাথে এই অঞ্চলের নানা গল্পের পাশাপাশি বইয়ের ভেতরে যেসব ঘটনা স্থান পেয়েছে সেগুলোরও একটা জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।'

সিরিয়ার 'নাবাল ওয়া আযযাহরা' শহরটির নারীরা দীর্ঘ চার বছর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে অবরুদ্ধ ছিল।

 

'ঝুলন্ত বাগানগুলো' বইটির লেখক এই বইয়ের নারী বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, 'এসব নারী প্রায় ১০ বছর ধরে বহুমুখী যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করেছে এবং এই ১০ বছরের মধ্যে চারটি বছর কাটাতে হয়েছে দুর্বিসহ অবরোধের মধ্যে। সেখানে তারা নিজেদের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে অবিরত সংগ্রাম করেছেন এবং আকাশ থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে কখন ত্রাণ সামগ্রী ফেলা হবে সেটার জন্য তাদের আকাশপানে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে।'

প্রতিরোধ সংগ্রামে সিরিয়ার নারীদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই লেখক বলেছেন, 'সিরিয়া এমন একটি ভূখণ্ড যা দীর্ঘদিন ধরে ফরাসি উপনিবেশ ছিল এবং এখন দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে এই ভূখণ্ডের সীমানা পড়েছে। সিরিয়ার গোলান মালভূমি ইহুদিবাদীরা দখল করে রেখেছে। এছাড়া বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনি অভিবাসীরা সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়ে সেদেশের মানুষের সাথে সহাবস্থান করছেন। শাম অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী তাদেরকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং তাদের মধ্যে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।  কাজেই ঔপনিবেশিকতা এবং ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্পর্কে এই সিরিয়ার মানুষ বিশেষকরে নারীদের বলার অনেক কিছু রয়েছে।'

নানা জাতির প্রতিরোধের গল্পের গুরুত্ব প্রসঙ্গে সুমাইয়া অলামি বলেন, 'যুদ্ধ ও পুনর্গঠনের পর্ব শেষে প্রতিরোধের ঘটনাগুলোর বর্ণনা পরিপক্কতায় পৌঁছায়। ইরান এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। ইরানি বর্ণনাকারীরা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী এবং বিশ্বের নানা জাতির প্রতিরোধের গল্প লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইরান পদক্ষেপ নিতে পারে।'

'ঝুলন্ত বাগানগুলো' বইটির লেখক আরও বলেছেন, 'নানা ঘটনা একই অঞ্চলের  বাসিন্দাদের পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং ঐসব ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ রাখার মাধ্যমে নতুন ও পুরনো ঔপনিবেশিকতার কবল থেকে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারে। এই ধরনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা না হলে জাতিগুলো প্রতিনিয়ত বহিরাগত ঔপনিবেশিকতা ও অভ্যন্তরীণ স্বৈরশাসনে নিপতিত হতেই থাকবে এবং তাতে আটকা পড়বে। যে জাতির কোনো ইতিহাস নেই এবং যারা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয় না তারা দ্রুত অদৃশ্য ও বিস্মৃত হয়ে যায়।'#  

পার্সটুডে/এসএ/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ