ডিসকভার ইরান: সাহিত্য থেকে সিনেমা ও সংগীত– খুজেস্তানের সমৃদ্ধ শৈল্পিক ঐতিহ্য
ইরানের খুজেস্তানের সাহিত্যে রয়েছে বহুমুখী কণ্ঠস্বর ও দৃষ্টিভঙ্গির সমাহার। এই প্রদেশের লেখকরা প্রায়ই যুদ্ধ, পরিচয় এবং নাগরিক জীবনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক, ঐতিহাসিক ও মানসিক বাস্তবতাকে তাদের রচনায় ফুটিয়ে তোলেন।
এই অঞ্চলের চলচ্চিত্র নির্মাতারা যুদ্ধ, দারিদ্র্য, পরিবার ও পরিচয় নিয়ে চিত্রনাট্য রচনা করেন, দক্ষিণের সাংস্কৃতিক ও আবেগঘন প্রেক্ষাপট থেকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে।
খুজেস্তানের সঙ্গীত জগৎও একটি সমৃদ্ধ চিত্রপট, যা এর জাতিগত বৈচিত্র্য এবং উত্তরাধিকার বোধ থেকে গড়ে উঠেছে। এটি আরবি ও ফার্সি ঐতিহ্যবাহী সুর, শাস্ত্রীয় বিন্যাস এবং আধুনিক সঙ্গীতের এক অপূর্ব মিশ্রণ।
ইরানের এই কৌশলগত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশটি তার বিপুল তেলের মজুদ এবং ১৯৮০-এর দশকের যুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকার জন্য বিখ্যাত। প্রায়শই এটিকে কেবল ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই পৃষ্ঠের নীচে রয়েছে এক সমৃদ্ধ, বহুজাতিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, যা ইরানের আধুনিক সাহিত্য, সিনেমা ও সঙ্গীতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
স্থল এবং জল সীমান্তের সান্নিধ্য খুজেস্তানকে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক সংযোগের অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে। এই ভূ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি প্রতিবেশী দেশগুলোর শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে।
সাহিত্য: দক্ষিণের গল্প
খুজেস্তানের সাহিত্য জীবনের যুদ্ধ, পরিচয় ও নগর বাস্তবতার প্রতিফলন। আহমদ মাহমুদ, খুজেস্তানের রাজধানী আহওয়াজের বাসিন্দা যিনি ইরানের অন্যতম প্রধান বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর 'পড়শিরা' (The Neighbors) উপন্যাসে দক্ষিণের নগরজীবন, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম এবং ২০ শতকের মধ্যভাগের রাজনৈতিক অস্থিরতা ফুটে উঠেছে।
আহওয়াজের মোস্তাফা মাস্তুর তাঁর দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার জন্য খ্যাত। তাঁর চরিত্রগুলো আধুনিক জীবনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে আধ্যাত্মিক অর্থ ও মানসিক স্বচ্ছতা খোঁজে।
খুজেস্তানের বন্দরনগরী আবাদানে জন্মগ্রহণকারী জোয়া পিরজাদ তার মৃদু, ন্যূনতম গদ্যের জন্য সুপরিচিত। তার গল্পগুলো প্রায়ই নারী ও পারিবারিক জীবনকে কেন্দ্র করে—মধ্যবিত্ত জীবনের নীরব সংঘাতগুলিকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করে এবং আর্মেনিয়-ইরানি অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করে।
দেজফুলের 'আহমদ দেহকান' যুদ্ধের ট্রমা নিয়ে লেখেন। তাঁর "Heading 270 Degrees" উপন্যাসে কিশোর সৈনিকের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।
কেইসার আমিনপুর, গোৎভান্দের কবি, "পবিত্র প্রতিরোধ" সাহিত্য আন্দোলনের এক অগ্রণী কণ্ঠ। তাঁর কবিতা—লিরিকধর্মী অথচ সামাজিকভাবে সক্রিয়—ঐতিহ্যবাহী রূপকে আধুনিক থিমের সাথে মিশিয়ে দেয়।
আবাদানের 'ফারহাদ হাসানজাদে' শিশু ও কিশোর সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর গল্পগুলো, যা স্নেহপূর্ণ আবেগে পূর্ণ এবং কিশোরদের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধ, অভিবাসন ও সহিষ্ণুতার থিমকে আবিষ্কার করে।
ঐতিহাসিকভাবে, খুজেস্তান 'আবু নুওয়াস' (আব্বাসীয় যুগের আরবি কবি), 'সাহল ইবনে হারুন' (প্রাথমিক ইসলামি যুগের লেখক), এবং শুশতারের 'আবুল আলা শুশতারি'র মতো ক্লাসিক সাহিত্যিকদেরও জন্মভূমি।
সিনেমা: পর্দায় দক্ষিণের কণ্ঠ
খুজেস্তান ইরানি সিনেমার ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আবাদানের নাসের তাঘভাই ইরানের নিউ ওয়েভ সিনেমার পথিকৃৎ। তাঁর "ক্যাপ্টেন খোরশিদ" (এর্নেস্ট হেমিংওয়ের "To Have and Have Not" এর দক্ষিণী রূপান্তর) স্থান ও চরিত্রের সমৃদ্ধ প্রকাশের জন্য প্রশংসিত।
আবাদানেরই আমির নাদেরি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পেয়েছেন "The Runner" ছবির মাধ্যমে, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে এক শিশুর বেঁচে থাকার গল্প বলা হয়েছে।
রুহুল্লাহ হেজাজির সিনেমাগুলো শোক, নীরবতা ও পারিবারিক টানাপোড়েনের থিমগুলো নিয়ে, প্রায়ই নীরব মানসিক বোঝার কথা বলে।
মেহরদাদ খোশবখত তাঁর "পালায়েশগাহ" চলচ্চিত্রে যুদ্ধ ও বাস্তুচ্যুতির মানসিক প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন, যা ১১০ বছর পুরোনো আবাদান শোধনাগারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
আবাদানের মানুচেহর মোহাম্মদি ইরানি সিনেমায় প্রযোজক ও নীতিনির্ধারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সিরুস মোগাদ্দাম, খুজেস্তান থেকে উঠে আসা, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ "পায়তাখ্ত" পরিচালনা করেছেন, যা সমকালীন ইরানি জীবনের হাস্যরস ও বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলে।
সঙ্গীত: ঐতিহ্য ও স্মৃতির সুর
খুজেস্তানের সঙ্গীত আরবি ও ফার্সি ঐতিহ্য, শাস্ত্রীয় বিন্যাস এবং আধুনিক সুরের এক অপূর্ব মিশ্রণ।
আহওয়াজের নোঝাত আমিরি ইরানে প্রথম নারী হিসেবে একটি অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করে লিঙ্গবৈষম্য ভেঙেছেন।
আহওয়াজের সাইয়েদ মোহাম্মদ কাজেম মুসাভি আরবি মাকাম ধারার সঙ্গীতে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
আবাদানের মোহাম্মদ শাহাবি স্থানীয় লোকসংগীতের ধারক ও বাহক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কিশোর প্রজন্মের মধ্যে খোররামশাহরের মোহসেন চাভোশি একজন জনপ্রিয় পপ-রক শিল্পী। রুমির কবিতা আধুনিক সুরে রূপান্তর করে তিনি ভালোবাসা, প্রবাস ও বেদনার প্রতিফলন ঘটান।
খুজেস্তানের সংস্কৃতি হলো বেদনা ও সহিষ্ণুতার, ঐতিহ্য ও উদ্ভাবনের, নীরবতা ও প্রকাশের এক শক্তিশালী মিশ্রণ। এর সাহিত্যিক, লেখক, চলচ্চিত্রকার ও সঙ্গীতশিল্পীদের মাধ্যমে আজও ইরানের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের আত্মাকে রূপ দিচ্ছে। এটি কেবল তেলের ভূমি নয়, এটি সেই ভূমি যেখানে এক একটি কণ্ঠস্বর সমগ্র জাতির হৃদয়ে অনুরণন তোলে।
লেখক: ফাতেমেহ তোরকশভান্দ, তেহরানভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক।