কেন ইরানিরা মার্কিন দূতাবাস দখলে নিয়েছিল?
(last modified Tue, 05 Nov 2024 12:46:05 GMT )
নভেম্বর ০৫, ২০২৪ ১৮:৪৬ Asia/Dhaka
  • কেন ইরানিরা মার্কিন দূতাবাস দখলে নিয়েছিল?

এই বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর মধ্যে একটি ছিল যে গোপন নথিগুলোর আবিষ্কার এবং এসব প্রকাশের মাধ্যমে এটা বোঝা গিয়েছিল যে দূতাবাস নামক সেই স্থানটি আসলে ছিল ষড়যন্ত্র পাকানোর একটি বড় কেন্দ্র।

১৩৫৮ সালের ১৩ অবনে শিক্ষার্থীরা ইরানে ইমামের আদর্শ মেনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এবং একটি বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তেহরানে আমেরিকান দূতাবাস দখল করে যেটি "গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া হিসাবে পরিচিতি পায়। ঘটনার দিন ছাত্ররা দূতাবাসে অনুপ্রবেশ করে এবং আমেরিকান নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পরে ভবনগুলোতে প্রবেশ করে। এই বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলির মধ্যে একটি ছিল ধ্বংসাত্মক দলিল আবিষ্কার এবং প্রকাশ।

মার্কিন দূতাবাস দখলের পটভূমি এবং কারণ

১. ক্ষমতাচ্যুত রাজাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া:

ছাত্রদের এই ব্যবস্থা গ্রহণের অন্যতম একটি প্রধান কারণ ছিল আমেরিকা কর্তৃক   ক্ষমতাচ্যূত শাহেনশাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভিকে আশ্রয় দেয়া। শাহের পালানোর পর আমেরিকা তাকে পুরানো মিত্র হিসেবে মেনে নেয় এবং আশ্রয় দেয়। ইরানের জনমতের মধ্যে এই পদক্ষেপটিকে  জনগণের ওপর পাহলভির অত্যাচারের প্রতি আমেরিকার সমর্থন এবং পাহলভি শাসনকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা হয়েছিল। এই আচরণ ইরানের সাথে আমেরিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।

৩. বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য আমেরিকান ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা:

দূতাবাস দখলের সময় উদ্ধারকৃত নথিগুলো দেখায় যে কিছু বিপ্লবী ব্যক্তির সন্দেহ সঠিক ছিল এবং এই স্থানটি বিপ্লববিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার এবং ইরানে নাশকতামূলক পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য একটি ঘাঁটি হিসাবে কাজ করেছিল। ফাঁস হওয়া নথিগুলো নাশকতামূলক গোষ্ঠীগুলোর সাথে দূতাবাসের ব্যাপক যোগাযোগ থাকার প্রতি ইঙ্গিত দেয়।

৪. একটি বিশৃঙ্খলা চক্র সৃষ্টিকে প্রতিরোধ করা:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,আমেরিকান দূতাবাস সক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে ইরানের ঐক্য ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে এবং দেশটিকে একের পর এক দাঙ্গায় জড়ানো এবং পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছিল।

৫. ২৮ মোরদদ ১৩৩২ সালে মার্কিন অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক ভয়  থেকে এই পদক্ষেপ:

১৩৩২ সালে মোসাদ্দেক সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকান-ব্রিটিশ অভ্যুত্থান এবং মোহাম্মদ রেজা শাহের ক্ষমতায় ফিরে আসার তিক্ত স্মৃতি এখনও ইরানিদের মনে বেঁচে ছিল। এই ঘটনাকে মার্কিন হস্তক্ষেপবাদী নীতি এবং ইরানের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ছাত্র ও অন্যান্য বিপ্লবীরা বিশ্বাস করতেন যে মার্কিন দূতাবাসে তার বাহিনী রেখে এবং তার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে পূর্ববর্তী শাসনের সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজ নিরাপত্তা এবং সামরিক উপাদানগুলির মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইছে।

দূতাবাস দখলের পরিণতি

দূতাবাস দখলের পর একের পর এক ঘটনা ঘটে। ইমাম খোমেনী (রহ.) এই পদক্ষেপকে "দ্বিতীয় বিপ্লব" বলে অভিহিত করেছেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে ইরান বিশ্বব্যাপী দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ইরানের আর্থিক চ্যানেলগুলোকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এছাড়াও, নথিগুলো পুনরায় পড়ার পরে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমেরিকার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনিকে হত্যা করা। পশ্চিমাদের চাপ এবং জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য আমেরিকান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই ঘটনাটি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে একটি স্থায়ী বিন্দু হয়ে ওঠে। যে বিন্দুতে ইরান তার ভাগ্যের উপর বৃহৎ শক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং একটি স্বাধীন পথ নিতে সক্ষম হয়েছিল। 

৪৪৪ দিন পর ইমাম খোমেনীর অনুমতিক্রমে এবং ইসলামিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে আলজেরিয়ার সরকারের মধ্যস্থতায় তৎকালীন ইরান সরকারের কর্মকর্তারা আমেরিকান কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে আলজেরিয়ান চুক্তি সম্পাদন করে এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক ও অধ্যাপক "ফ্রান্সিস অ্যান্থনি বয়েল" তার "বিশ্ব রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন" বইতে ছাত্রদের জিম্মি করার বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন এবং এই পদক্ষেপকে ইরানের আইনানুযায়ী আত্মরক্ষার অধিকার বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ৫১তে  তিনি আগ্রাসন ঠেকাতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা থেকে বিরত রাখতে ছাত্রদের এই আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন।এরপর থেকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ওয়াশিংটনে দূতাবাস স্থাপনের অনুরোধে রাজি হয়নি। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করতে আমেরিকার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হল মার্কিন দূতাবাসের অনুপস্থিতি।

পার্সটুডে/এমবিএ/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ