অক্টোবর ১৩, ২০২০ ১৮:৫১ Asia/Dhaka
  • ইরাকে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের একটি দৃশ্য
    ইরাকে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের একটি দৃশ্য

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমি গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর ইরাকের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমি গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি ছাড়াও আগামী তিন বছরের মধ্যে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার বিষয়ে মোটামুটি একটি সমঝোতায় পৌঁছান।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন ঘটে এবং পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। মোস্তাফা আল কাজেমির ওই সফরের পর ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলার ঘটনা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এসব হামলার জন্য ইরাকের প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে অভিযুক্ত করে বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। তবে ইরাকের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠনগুলো এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, মার্কিন অনুচররাই পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরাকের জনপ্রিয় প্রতিরোধে সংগঠনগুলোর বদনাম করা। ‌

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমি সরকারবিরোধী বিক্ষোভের এক বছর পূর্তিতে বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস বন্ধের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের হুমকি গ্রহণযোগ্য নয়। ইরাকের কোন কোন মহল মনে করছেন দূতাবাস বন্ধের হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসলে অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। ইরাকের জনমনে এখন এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বন্ধের হুমকি দিয়ে ইরাকের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি এবং এ দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র এটা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়া হলে কিংবা ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে বাগদাদের স্বার্থ রক্ষা হবে না। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে সে দেশে মার্কিন সেনা উপস্থিতির বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে।

সরকারবিরোধী বিক্ষোভের এক বছর পূর্তিতে দেয়া ভাষণে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজেমী আরো বলেছেন, তার দেশকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার হুমকি সরাসরি দেশটির অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ ইরাকের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হোসেনও টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, আমরা আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এমনকি পাশ্চাত্যের আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওয়াশিংটন যাতে বাগদাদে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তবে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তাফা আল কাজেমি মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দেয়ার পরিণতির ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেয়ার পাশাপাশি সে দেশ থেকে ২৫০০ মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার খবর দিয়ে বলেছেন ইরাক জবরদখল করে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে অসংখ্য ভুল করেছে।

ধারণা করা হচ্ছে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী তার এসব বক্তব্যের মাধ্যমে একদিকে সে দেশে মার্কিন সেনা উপস্থিতি বজায় রাখার ক্ষেত্র তৈরীর চেষ্টা করছেন অন্যদিকে তার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর সমালোচনাও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কেননা আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি মোস্তাফা আল কাজেমিকে ভাবতে হচ্ছে।

এদিকে, ইরাকে মার্কিন সেনা উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক তীব্রতর হওয়া ছাড়াও গত একমাসে মোস্তাফা আল কাজেমি সরকারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ইরাকের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও পার্লামেন্ট প্রতিনিধিরা বক্তব্য দিয়েছেন। ইরাকের ইসলামী উচ্চ পরিষদ সাইরি দলের নেতা বাকের জবরুল যাবেদি সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাথ পার্টির অবশিষ্ট কিছু সমর্থকদের নতুন করে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত পার্টির সদস্যদের সম্মেলন থেকে বোঝা যায় তারা ইরাকে সশস্ত্র সামরিক তৎপরতা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইরাকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী বাকের জবরুল যাবেদি আরো বলেন, যারা এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করেছে তারা ইরাক থেকে পলাতক ব্যক্তি । তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে ইরাকে সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত চলছে। আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের অনুগত ইজ্জাত আল দাউরি এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত সাদ্দামের বাথ পার্টির অবশিষ্ট সদস্যরা ইরাকের দিয়ালা প্রদেশ সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

যদিও এটা বলা কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে পার্টিকে ফের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছে কিন্তু এটাও ঠিক যে নিষিদ্ধ ঘোষিত এই ধরনের কর্মীরা ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের হয়ে কাজ করছে। এছাড়া বাথ পার্টির লোকেরা ইরাকে নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতা উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত বছর অক্টোবরে ইরাকের বিভিন্ন সড়কে সরকার বিরোধী যে বিক্ষোভ হয়েছিল তাতে উস্কানি দেয়ার ক্ষেত্রে বাথ পার্টির সদস্যদের বড় ভূমিকা ছিল। ওই বিক্ষোভ এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত আদেল আব্দুল্লাহ মাহদি সরকার ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিল।

যাইহোক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পার্লামেন্টসহ দেশটির ক্ষমতার বিভিন্ন কাঠামোতে নিষিদ্ধ-ঘোষিত বাথ পার্টির সদস্যদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। কারণ ইরাকের পার্লামেন্টে বিভিন্ন মতের অনুসারীদের উপস্থিতি রয়েছে এবং বহু বিষয়ে তারা একমত নয়। এই সুযোগে দেশটির শক্তিশালী শিয়া সংগঠনের অবস্থান দুর্বল করে দেয়ার জন্য ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ইরাকি পার্লামেন্টে 'আল ফাতাহ' জোটের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আল-বালাদাভি যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি আরব দেশের নতুন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, আমেরিকা ও তার আরব মিত্ররা ইরাকের রাজনৈতিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ ঘোষিত সাদ্দামের বাথ পার্টির সদস্যদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে‌।

এই সব ষড়যন্ত্র কয়েকটি দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্ররা এবং দখলদার ইসরাইল এখন থেকেই ইরাকে আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য নীলনকশা প্রণয়ন করছে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ইরাকের রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা। দ্বিতীয়ত, ইরাকের শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি সম্প্রদায়ের মধ্যকার কোনো কোনো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকার সমর্থন নিয়ে তারা এখন থেকেই আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি শুরু করেছে। তৃতীয়ত, আগামী মাসগুলোতে ইরাকজুড়ে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সংকট সৃষ্টি এবং ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে যার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রতিরোধকামী সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

ট্যাগ