ঈদুল আজহা: হৃদয় ও সমাজ পরিশুদ্ধ করার সুযোগ এবং আসক্তি থেকে মুক্তির প্রতীক
পার্সটুডে : একজন হাদিস গবেষকের মতে, ঈদুল আজহা সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.)-এর বংশধর, ইমাম রেজা (আ.)-এর বাণী শুধু বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি নৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের আহ্বান।
পার্সটুডে জানিয়েছে, মেহের নিউজ এজেন্সির সাথে সাক্ষাৎকারে হাদিস গবেষক ও ইরানি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুজ্জাতুল ইসলাম জাওয়াদ আফশারি বলেন, ইমাম রেজা (আ.)-এর শিক্ষায় ঈদুল আজহার নৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, "ইমামের বাণীতে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহা হলো পরিশুদ্ধির দিন। ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,
"يَوْمُ الْأَضْحَی يَوْمُ الطَّهَارَةِ وَ الْعَفْوِ وَ الْعَطَاءِ"
অর্থ: কুরবানির দিন হলো পবিত্রতা, ক্ষমা ও দানের দিন।
এই দিনে হৃদয়কে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে মুক্ত করে সহনশীলতা ও ক্ষমার মাধ্যমে সমাজকে ঐক্য ও সহমর্মিতার পথে এগিয়ে নেওয়া উচিত।
অধ্যাপক জাওয়াদ আফশারি আরও বলেন, ইমাম রেজা (আ.) তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে এই শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি ঈদুল আজহায় নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন, মানুষের সাথে সদয় আচরণ করতেন এবং কুরবানির গোশতের একটি বড় অংশ দরিদ্র ও এতিমদের মধ্যে বিতরণ করতেন। তিনি বলতেন,
"الصَّدَقَةُ فِی هَذَا الْيَوْمِ أَفْضَلُ مِنْ غَيْرِهِ"
অর্থ: এই দিনে দান-সদকা অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে উত্তম।
আফশারি জোর দিয়ে বলেন, "আজ যদি আমাদের সমাজ নৈতিক সংকট ও সামাজিক বিভেদের মুখোমুখি হয়, তাহলে ঈদুল আজহা সম্পর্কে ইমাম রেজা (আ.)-এর শিক্ষার দিকে ফিরে যাওয়া উচিত। ঈদুল আজহা হলো মানবিক সম্পর্ক পুনর্গঠন, হৃদয়ের মালিন্য দূর করা এবং ক্ষমা ও ত্যাগের অনুশীলনের দিন।"
কুরবানি: নির্ভরতামুক্তির প্রতীক
ইসলামিক ইতিহাসের গবেষক মুহাব্বাত সাফফারি মেহের নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমাম রেজা (আ.)-এর দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরবানির দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, "ঈদুল আজহা মানবতার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার স্মারক—যেখানে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের সন্তানকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ইমাম রেজা (আ.) এই ঘটনার পুনর্ব্যাখ্যায় জোর দিয়েছেন যে, মানুষের উচিত বস্তুগত ও আবেগগত নির্ভরতা থেকে মুক্ত হওয়া।"
তিনি বলেন, "ইতিহাস ও হাদিসের বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইমাম রেজা (আ.) কুরবানিকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রশিক্ষণ হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, মানবিক উন্নতি ও সৌভাগ্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুনিয়ার মোহ। ঈদুল আজহা হলো এই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া এবং নিজের ঈমান ও নিষ্ঠার পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ।"
সাফফারি উল্লেখ করেন, ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,
"عَلَيْكُمْ بِالتَّضْحِيَةِ، فَإِنَّهَا سُنَّةُ إِبْرَاهِيمَ وَ سُنَّةُ مُحَمَّدٍ (ص) وَ عَلاَمَةٌ عَلَى التَّسْلِيمِ لِلَّهِ
অর্থ: তোমরা কুরবানি করো, কারণ এটি ইব্রাহীম (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)-এর সুন্নত এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের নিদর্শন।
এই বাণী প্রমাণ করে যে, কুরবানির দর্শন কেবল পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ত্যাগ, আত্মসমর্পণ ও নিষ্ঠার প্রস্তুতিতে নিহিত।
তিনি আরও বলেন, "ইমাম রেজা (আ.) ঈদুল আজহা ও হৃদয় পরিশুদ্ধির মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতেন। তিনি বলতেন, মুমিনের উচিত প্রতিটি কুরবানির সাথে সাথে দুনিয়ার মোহও স্বার্থপরতাকেও বিসর্জন দেওয়া, যাতে হৃদয় আল্লাহর নূর গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়।"
এই ইসলামী ইতিহাস গবেষক আরও বলেন, আহলে বাইতের (আ.) শিক্ষা অনুযায়ী ঈদুল আজহা সবসময় ছিল এক ধরনের বাস্তব ও সামাজিক আধ্যাত্মিকতার প্রশিক্ষণের উপলক্ষ। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিতেন এই দিনে শুধু নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণ ও বরকতের প্রার্থনা করতে।
সাফারি শেষ মন্তব্যে বলেন, আজকের সমাজ যদি ইমাম রেজা (আ.)-এর দৃষ্টিতে ঈদুল আজহার বার্তাগুলোকে পুনর্জাগরিত করতে পারে, তবে আমরা আশা করতে পারি যে নৈতিক সঙ্কট, অতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিকতা এবং সামাজিক বিভাজন অনেকটাই দূর হবে এবং তার জায়গায় আসবে মানবিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও ঐক্য।#
পার্সটুডে/এমএআর/৭