বিশ্বব্যবস্থায় ফ্রান্সের রাজনৈতিক প্রভাব কীভাবে নিষ্প্রভ হয়ে উঠল?
-
বিশ্বব্যবস্থায় ফ্রান্সের রাজনৈতিক প্রভাব কীভাবে নিষ্প্রভ হয়ে উঠল?
পার্সটুডে-গত কয়েক বছরে ফ্রান্স তার রাজনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বর্তমান সমীকরণে ফ্রান্সের আগের মতো প্রভাব নেই।
পার্সটুডে'র মতে, ফ্রান্স, ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশবাদী, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, পারমাণবিক ক্লাব এবং ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক বিষয়ে একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এসেছে। এমনকি জার্মানির পাশাপাশি ফ্রান্সও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সেই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে গেছে। এখন এমনকি পশ্চিমা থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোও বিশ্বাস করে যে গত কয়েক বছরে ফ্রান্স তার রাজনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়েছে।
ম্যাক্রনের পদত্যাগ করা কি ফ্রান্সের জন্য ভালো হবে?
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন এই আশায় যে লু পেন এবং উগ্র বামপন্থীদের ভয় ফরাসি ভোটারদের হয়তো ভীত করে তুলবে। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল লু পেন বিপুল ভোটে জিতে গেছে এবং ম্যাক্রনের ব্লক বামপন্থীদের সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়েছে। তার কিছু পরেই তিনি বামপন্থী মিত্রদের ত্যাগ করে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ওই চুক্তি অনুযায়ী লু পেন অভিবাসন নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছাড়ের বিনিময়ে মিশেল বার্নিয়ার নেতৃত্বে একটি মধ্যপন্থী-রক্ষণশীল সরকারকে সমর্থন দেবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন ম্যাক্রোঁর পদত্যাগ করাই ভালো হবে। কারণ ১৯৬৯ সালে ম্যাক্রোঁর তুলনায় অনেক কম ব্যর্থতার জন্য দ্য গোল ক্ষমতা ছেড়েছিলেন। কাজেই ম্যাক্রনও যদি এমন পদক্ষেপ নেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৭ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তার পক্ষে টিকে থাকা খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে ফরাসি সরকারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
প্যারিস থেকে মুদ্রিত বিখ্যাত সংবাদপত্র লা ফিগারো জানিয়েছে যে ফ্রান্সের বিদেশী প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই হ্রাস পাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক সংকটে ফ্রান্সের তেমন কোনো ভূমিকা এখন আর নেই।
লা ফিগারো আরও স্বীকার করেছে: ২০১৭ সালে ইমানুয়েল ম্যাক্রন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এলিসি প্রাসাদে প্রবেশের পর থেকে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেই সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রতি জনসাধারণের অসন্তোষ এবং সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি তার অবজ্ঞা। যার ফলে বৃহত্তর বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।
আঙ্কারা-ভিত্তিক ইংরেজি ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র সাবাহ এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে। ওই প্রতিবেদনে চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে: সংসদীয় নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গেছে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পূর্ণরুপে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। এখন ফরাসি রাজনৈতিক মহলসহ কর্মী পর্যায়ের লোকেরাও খুব ভালো করেই জানে যে ম্যাক্রনের অযোগ্যতার কারণেই ফরাসি রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ওই সমস্যার পাশাপাশি আরও একটি সমস্যা রয়েছে। তা হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওই দেশটির প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
ইউরোপেও ফ্রান্সের উপস্থিতি নিষ্প্রভ
ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি সর্বদা ওই ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে স্বীকৃত। এ কারণে তাদের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমগ্র ইউনিয়নের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
কুইন্সি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র গবেষক 'আনাতোল লিয়ন' এ বিষয়ে সুন্দর একটি কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যটি ছিল এরকম: ফ্রান্স এবং জার্মানি দুটি দেশই ইউরোপীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ মাত্র এক মাসের মধ্যে উভয় দেশের সরকার ভেঙে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাজেট ঘাটতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে দুটি দেশেই উত্তেজনা বিরাজ করছে।
উভয় ক্ষেত্রেই, তাদের আর্থিক সমস্যা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা ব্যয়ের কারণে নিজেদের কল্যাণ বাজেটের উপর চাপ ভয়াবহ রকমে বেড়ে গেছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, ফ্রান্সে আর্থিক সংকট মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে পতনের দিকে নিয়ে গেছে। পক্ষান্তরে চরমপন্থী ও উগ্র রাজনীতিবিদদের বিকাশের পথ সুগম হয়েছে।
পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস
গত কয়েক বছর ধরে ফ্রান্স একটি বিদেশী হস্তক্ষেপকারী শক্তি হিসেবে লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন অপকৌশলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা মোটেও সফল হয় নি, চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং একথা নির্বিঘ্নে বলা যেতে পারে যে, লেবাননের রাজনৈতিক সমস্যার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ফরাসি ব্যর্থ নীতির পরিণতি। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ ছাড়াও, অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনও সেদেশের দক্ষিণপন্থী খ্রিষ্টান দলের নেতা সামির জা'জা-কে সমর্থন করতে রাজি নয়। কারণ ফ্রান্স এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের কাছে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতির ফলে জনগণের কাছে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই কিংবা তার জনসমর্থনও নেই।
লেবানন এবং সিরিয়ার পাশাপাশি, আফ্রিকাতেও ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যর্থতা উল্লেখযোগ্য। লিবিয়ায় সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য ফ্রান্সের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে ছিল। তা সত্ত্বেও আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ এই দেশটি প্যারিসের দাবির প্রতি খুব কমই মনোযোগ দেয়। তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া এবং চাদের মতো আফ্রিকার অপরাপর দেশগুলোতেও ফ্রান্স তাদের প্রভাব চরমভাবে হারিয়ে ফেলেছে।#
পার্সটুডে/এনএম/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।