কেন ট্রাম্পের 'শক্তির মাধ্যমে শান্তি' মডেল ব্যর্থ হলো?
-
ট্রাম্প
পার্সটুডে- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'শক্তির মাধ্যমে শান্তি' প্রতিষ্ঠার নীতি বাস্তবে আমেরিকাকে এক অবিশ্বস্ত, অস্থিতিশীল এমনকি চাপ প্রয়োগকারী শক্তিতে পরিণত করেছে। এই নীতি ইউরোপকে দুর্বল করেছে, চীনকে শক্তিশালী করেছে এবং আরব দেশগুলোকে আমেরিকার প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলেছে।
পার্সটুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিটা ছিল এমন-সামরিক শক্তি প্রদর্শন করা হবে, অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া হবে, শত্রুদেরকে হুমকি-ধমকির মাধ্যমে ভয় দেখানো হবে এবং মিত্রদেরকে মার্কিন পথ অনুসরণে বাধ্য করা হবে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে- এই নীতি শান্তি আনে নি; বরং আমেরিকাকে এক অবিশ্বস্ত, অস্থিতিশীল এবং জবরদস্তি-কেন্দ্রিক শক্তিতে পরিণত করেছে। এই নীতির অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও আঞ্চলিক ফলাফল আমেরিকার বৈশ্বিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে।
১. মিত্রদের প্রতি অবহেলা এবং বিশ্বাসের সংকট
চাপ ও জোরজবরদস্তি হয়তো সাময়িক ফল দিতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা বিশ্বাস ও আস্থা ধ্বংস করে। এমনকি আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও বুঝে গেছে যে, ওয়াশিংটন প্রয়োজন হলে নিজের বন্ধুদেরও ত্যাগ করতে পারে। ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন, সম্পদ ও জ্বালানি স্বার্থে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা, লাতিন আমেরিকায় উত্তেজনা বাড়ানো—এসব আচরণ বহু দেশের চোখে আমেরিকাকে এক অবিশ্বস্ত অংশীদারে পরিণত করেছে।
২. অর্থনৈতিক ব্যর্থতা: চীনের শক্তি বৃদ্ধি, ইউরোপের দুর্বলতা
পশ্চিমা থিংক ট্যাংকগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে—ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিই ইউরোপের বাজার চীনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ইউরোপ চীনা পণ্যে সয়লাব হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজের বিষয়ে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে ইউরোপের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দুর্বল হয়, বিপরীতে চীন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে—যা ট্রাম্পের ঘোষিত লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। অর্থাৎ, আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী লাভবান হয়েছে, আর দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৩. নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ব্যর্থতা: জোটকে ‘বাজির দোকান’ বানানো
ফরেন পলিসি সাময়িকী'র ভাষায়, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘মাফিয়া-সুলভ’। আমেরিকা নেতৃত্ব দেয়নি—বরং মিত্রদের কাছ থেকে নিরাপত্তা বাবদ বেশি টাকা আদায় করেছে। ন্যাটোসহ অন্যান্য মিত্র দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে ভয় ও অনিশ্চয়তার কারণে, আস্থার কারণে নয়।
৪. আঞ্চলিক ব্যর্থতা: আরব দেশগুলোর অবিশ্বাস
দখলদার ইসরায়েলের ১২ দিনের ইরানবিরোধী হামলা এবং কাতারে হামলার সময় আমেরিকা নিজ মিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার সক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে। বার্তা ছিল স্পষ্ট—যে দেশ সংকটাপন্ন ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে তার মিত্রদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করবে?
৫. গণমাধ্যমের গল্প বনাম বাস্তবতা
ট্রাম্পপন্থী গণমাধ্যম ‘বিশ্বব্যাপী সম্মান’, ‘দৃঢ় প্রতিরোধ ক্ষমতা’ বা ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’—এ ধরনের স্লোগান দিয়ে শক্তির এক চকচকে চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল উল্টো—ইউরোপ দুর্বল হয়েছে, চীন শক্তিশালী হয়েছে, মিত্ররা আস্থা হারিয়েছে এবং বিশ্বব্যবস্থা অস্থির হয়ে পড়েছে। এই প্রচার ও বাস্তবতার তীব্র বৈপরীত্যই “শক্তির মাধ্যমে শান্তি” মডেলের ভাঙ্গনকে স্পষ্ট করেছে।
অবশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের মডেল না শান্তি সৃষ্টি করতে পেরেছে, না দীর্ঘস্থায়ী শক্তি গড়তে পেরেছে বরং এটি বিশ্বে আরও অস্থিরতা, অবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাস করেছে। ভেনেজুয়েলার মতো সংকট যদি যুদ্ধের দিকে গড়ায়, তাহলে সবার মধ্যে এই ধারণা আরও বেশি দৃঢ় হবে। চাপ ও হুমকির নীতি শান্তি নয়, বরং অস্থিতিশীলতা তৈরি করে-এ কথা আরও জোর দিয়ে বলা যাবে।
এ পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কাজ হলো সহিংসতার যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা, আমেরিকার এই নীতির বিশ্বাসযোগ্যতাহীনতা তুলে ধরা এবং বাস্তবতা স্পষ্ট করে তুলে ধরা।#
পার্সটুডে/এসএ/৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন