ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে উগ্র ওয়াহাবিরা
(last modified Tue, 27 Mar 2018 09:52:48 GMT )
মার্চ ২৭, ২০১৮ ১৫:৫২ Asia/Dhaka
  • ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে উগ্র ওয়াহাবিরা

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ধর্মের নামে বিকৃত ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সৌদি রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজের সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফরের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই দেশ দু'টিতে ওয়াহাবি মতবাদের আরো বিস্তার ঘটায় ওই অঞ্চলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ধর্মের নামে বিকৃত ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সৌদি রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজের সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফরের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই দেশ দু'টিতে ওয়াহাবি মতবাদের আরো বিস্তার ঘটায় ওই অঞ্চলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

মালয়েশিয়ার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেদেশে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। তাদের মতে, অন্যান্য দেশের মতো ওয়াহাবিরা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বিশেষ করে তথাকথিত বিভিন্ন ইসলামি দল ও সংগঠনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। এভাবে তারা সরকারের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ ও এমনকি প্রশাসনেও জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করছে। মালয়েশিয়ায় এখন ওয়াহাবি মতবাদের পক্ষে নানান তৎপরতা ও প্রচারণা চোখে পড়ার মতো। এ কারণে দেশটির বিভিন্ন মহল সেদেশে ওয়াহাবি মতবাদের প্রচার ও প্রসারের পরিণতির ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আহমাদ ফুজি আব্দুল হামিদ বলেছেন, "মালয়েশিয়ায় উগ্র ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তারে সৌদি আরবের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কেননা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সরকারি স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সর্বস্তরে ওই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ধর্মের নামে বিকৃত ওয়াহাবি চেতনার বিস্তার আরো বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছে সবাইকে।"

মালয়েশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তারের পর ওয়াহাবিরা দেশটির বিচার বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগেও নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। মালয়েশিয়ার সচেতন ধর্মীয় নেতারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ওয়াহাবি নেতারা ইসলামি শিক্ষার ভুল ব্যাখ্যার কারণে সেদেশে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালয়েশিয়ায় শিয়া মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা এরই আলোকে মূল্যায়ন করতে হবে।

মালয়েশিয়ায় ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের অনুসারীরা শত শত বছর ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে। এ অবস্থায় সেখানে ওয়াহাবিদের প্রভাব বিস্তারের পরিণতির ব্যাপারে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল মোতালেব আব্দুর রহিম বলেছেন, "সরকারের উচিত এখনই ওয়াহাবিদের বিকৃত মতবাদ ও শিক্ষা প্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া।" তিনি বলেন, "সৌদি আরবের কাছ থেকে অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে স্থানীয় যেসব গ্রুপ ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে তাদের মোকাবেলা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।"  

মালয়েশিয়ার নেগরি সেম্বিলান প্রদেশের মুফতি উগ্র ওয়াহাবি মতবাদকে হারাম ঘোষণা করে বলেছেন,  "এ মতবাদের সঙ্গে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই।" তিনি বলেন, "পেরলিস শহরের আহলে সুন্নাত, জোহার শহরের হারকাতে সুন্নাত, পাহাঙ্গ শহরের আউরাঙ্গ সুন্নাতের মতো বিভিন্ন স্থানীয় ধর্মীয় গোষ্ঠী সৌদি আরবের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়ে মালয়েশিয়ায় ওয়াহাবি মতবাদের প্রচার চালাচ্ছে।"

মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড মালয়েজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন দলের এক কর্মকর্তা মুফতি মুহাম্মদ আসরি যেইনুদ্দিন পেরলিস প্রদেশে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়াহাবি মতবাদ বিস্তারের সমালোচনা করে বলেছেন, ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে মালয়েশিয়া খুব শিগগিরি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মুখোমুখি হবে।

গত কয়েক বছরে ইন্দোনেশিয়ায়ও ওয়াহাবিদের প্রভাব বিস্তারের কারণে শান্তিপূর্ণ এ দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশঙ্কা বহুগুনে বেড়েছে। অথচ শান্তি ও সাম্যের বাণী নিয়ে ইন্দোনেশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ইসলামের আগমন ঘটেছিল। ওই অঞ্চলের জনগণ বহুকাল ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে। ইন্দোনেশিয়ায় তৎপর উগ্র ওয়াহাবিদের অন্যতম একটি কৌশল হচ্ছে অর্থ সহযোগিতা ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে জনগণের সমর্থন লাভ। এ ছাড়া, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানে যুবকদেরকে ওয়াহাবি মতবাদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা যুবকদেরকে পড়াশোনার জন্য সৌদি  আরবে পাঠাচ্ছে এবং সেখান থেকে উগ্র মুফতিদের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে তারাও উগ্র ওয়াহাবি মতবাদ বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। অথচ ইন্দোনেশিয়ার জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওয়াহাবিদের প্রচারিত মতবাদের কোনো মিল নেই। এমনকি মাজার যিয়ারত ও নবী বংশ বা আহলে বাইতের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধারমতো বিষয়গুলোতে শিয়া মুসলমানদের সাথে সুন্নি মুসলমানদের কোনো পার্থক্য নেই।

ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ সাহিব হেবলি বলেছেন, "দুঃখজনকভাবে সৌদি ঘেঁষা ওয়াহাবিরা ইন্দোনেশিয়ার জনগণের সহজসরলতার অপব্যবহার করছে। মক্কা কিংবা মদিনা থেকে কেউ এলে জনগণ তাদেরকে অনেক শ্রদ্ধা করে এবং তাদের প্রতিটি কথা বা বক্তব্যকে ধর্মের বাণী হিসেবে গ্রহণ করে। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে ওয়াহাবিরা।"

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াহাবিরা ইন্দোনেশিয়ায় শিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। সৌদি আরবে অবস্থিত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষার্থীদের এ শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে যে, শিয়ারা কাফের এবং তাদেরকে কোনোভাবেই মুসলমান বলা যায় না। এ ভাবে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য তারা সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ওয়াহাবিদের ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য সেদেশের ধর্মীয় নেতাদের কাধে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাবরি নুরান বলেছেন, "সেদেশের সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়া ওয়াহাবিদেরকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ তারা ওয়াহাবি মতবাদের কথা উল্লেখ না করেই সহজে ধর্মের নামে সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে। ওয়াহাবিরা  ইন্দোনেশিয়ার স্কুলগুলোতে এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং জনগণকে তাদের ধর্মীয় আলোচনা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।"  তাদের এসব তৎপরতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি বলে ইন্দোনেশিয়ার এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন।"  

যাইহোক, সৌদি আরব ইয়েমেনে গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি সিরিয়া ও লেবাননে সন্ত্রাসীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে প্রমাণ করেছে, মুসলিম বিশ্বকে দুর্বল করা এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে রিয়াদ। এ লক্ষে সন্ত্রাসীদের অর্থ ও অস্ত্র দেয়ার পাশাপাশি তারা ধর্মের নামে বিকৃত ওয়াহাবি মতবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। আর সন্ত্রাসীদের চিন্তাচেতনার মূল শেকড় হচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদ।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ওয়াহাবিরা মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করছে এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলোকেও তারা ব্যবহার করছে। এ অবস্থায় তাদের মোকাবেলা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে জনগণকে সচেতন করা এবং এ দু'দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৭

 

ট্যাগ