ইরানের ১৫ খোরদাদ বা ঐতিহাসিক ৫ জুনের গণজাগরণ
(last modified Sat, 03 Jun 2023 10:20:31 GMT )
জুন ০৩, ২০২৩ ১৬:২০ Asia/Dhaka
  • ইরানের ১৫ খোরদাদ বা ঐতিহাসিক ৫ জুনের গণজাগরণ

জেগে ওঠো যদি তুমি, আর আমিও যদি জাগি একবার দুরন্ত দূর্বার!  তাহলে জেগে উঠবে সবাই! হ্যাঁ! সবাই! হে প্রিয় বোন ভাই-বেরাদার! তুমি যদি বসে থাকো, আমিও যদি বসে থাকি- হয়ে থাকি নীরব নিস্তব্ধ 

তাহলে জেগে উঠবে কারা? লড়াই করে করবে কারা শত্রুকে জব্দ? 
এসো পাহাড়ের মতো হই অবিচল নদীর মতো উদ্দাম 
বিজয় আমাদের হবেই হবে সফল হবে আমাদের সংগ্রাম!
পর্বত-নদী-উপত্যকায় চিরসবুজ চির-প্রোজ্জ্বল রবে আমাদের নাম! 
মুক্তমনা সংগ্রামীরা এক অভিন্ন জাতি যেন রক্তের ভাই 
ফিলিস্তিনি আফগানি রোহিঙ্গা কিংবা বাঙ্গালি কোনো প্রভেদ নাই!

রক্তাক্ত ১৫ই খোরদাদ ইরানের সমকালীন ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় এক দিবস। স্বৈরাচারী শাহ সরকারের কঠোর সমালোচনার জন্য ১৯৬৩ সালের ৩ জুন ইমাম খোমেনীকে গ্রেফতার করা হয় এবং সারাদেশে মিছিল সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু ইমামের মুক্তির দাবিতে ৫ জুন তেহরান ও অন্যান্য শহরের জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন। তারা স্লোগান দিতে শুরু করেন ‘হয় খোমেনী, না হয় মৃত্যু’। শাহের পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে শুধু তেহরানেই ১৫ হাজার লোক শাহাদাত বরণ করেন। ১৫ খোরদাদের গণ-অভ্যুত্থানকে ইসলামী বিপ্লবের সূচনা-পর্ব ধরা হয়। তাই তারিখটি ইরানী ইসলামী বিপ্লবের জন্য একটি মাইলফলক। 


ইমাম খোমেনী তাঁর একটি কবিতায় ইরানী বর্ষপঞ্জির খোরদাদ মাসের মাঝামাঝি সময়েই তাঁর ওফাতের আশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাই হয়েছিল। 

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ.) ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের একমাস পর ১৫ই খোরদাদ আন্দোলন সম্পর্কে বলেছিলেন, "ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে ১৫ই খোরদাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যারা সেদিন শাহী অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তারাই প্রকৃতপক্ষে ইসলামী বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন।"

১৯৬০ এর দশকে মরহুম ইমাম খোমেনী (রহঃ) ইরানী জনগণের জন্য দু'টি মহান কাজ করেন। তিনি কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে স্বৈরাচারী শাহ সরকার এবং তার মার্কিন প্রভুর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা করেন এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখার ষড়যন্ত্র বানচাল করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি তিনি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন। এরকম এক প্রেক্ষাপটে ১৫ খোরদাদের বিপ্লব সংঘটিত হয়ে। 

ফার্সি বছরের তৃতীয় মাসের নাম খোরদাদ এবং এই মাসের ১৫ তারিখে ওই গণ-জাগরণ সংঘটিত হয়েছিলো বলে এর নাম ১৫ খোরদাদ আন্দোলন। ইরানের পূর্ববর্তী গণ-বিপ্লব বা গণ-জাগরণগুলোর সাথে এর পার্থক্য ছিল এই যে, এতে ধর্মীয় আবেদনের বিষয়টি ছিল প্রখর। সে সময় ইরানের অত্যাচারী শাহ সরকার দেশ থেকে ইসলাম উৎখাতের ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল।  অথচ ইরানের বেশিরভাগ জনগণ ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই ছিল ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং এ কারণে তারা সরকারের ধর্ম বিদ্বেষী পদক্ষেপগুলোকে ভালোভাবে নিতে পারছিলো না। কিন্তু তাদেরকে সুসংগঠিত করতে ইমামের আগে আর কোন ধর্মীয় নেতা যথেষ্ট জোরালোভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে এগিয়ে আসেন নি। শাহ সরকারের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনগণকে আন্দোলনে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ইমাম তৎকালীন দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়ন- কারো সাহায্যই গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেন নি।

১৯৬৩ সালের জুন মাসে সংঘটিত ১৫ই খোরদাদ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত ইমামের নেতৃত্বে ইরানী জনগণের শ্লোগান ছিলো- 'পূর্বও নয় পশ্চিমও নয় তথা প্রাচ্যও নয় পাশ্চাত্যও নয় ইসলামী প্রজাতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ'। ১৫ই খোরদাদের বিপ্লবের দিন শাহের পেটোয়া বাহিনী হাজার হাজার মানুষকে শহীদ করে। নির্বাসনে পাঠানো হয় ইমামকে। শাহ সরকার ভেবেছিলো, এর মাধ্যমে দেশে তার ইচ্ছা অনুযায়ী শান্ত অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে গণ-অসন্তোষই আরও ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী পক্ষগুলো বিশ্বকে নতুনভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। বহু দেশ এ সময় স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯৫০ এর দশকের গোঁড়ার দিকে ইরানেও এর প্রভাব পড়ে। জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। সে সময় আন্দোলনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আলেম সমাজও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

অবশ্য সে সময় সংগ্রামী আলেম আয়াতুল্লাহ কাশানি ও মোসাদ্দেকপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য ও সমন্বয় না থাকায়, বিশেষ করে ডক্টর মোসাদ্দেক মার্কিন সরকারকে বন্ধু মনে করে ওই সরকারের দিক থেকে পরিচালিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উদাসীন থাকায় ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে ইঙ্গোমার্কিন ষড়যন্ত্রে জন-নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটে এবং জনগণের আন্দোলন আরেকবার অস্ত্রের জোরে দমন করা হয়। কিন্তু ঐ ঘটনার ১০ বছরের মাথায় তেহরান ও কোম শহরসহ সারাদেশে পুনরায় সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এবারের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইমাম খোমেনী (রহ.) এবং তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৫ই খোরদাদের প্রবল গণজাগরণ শুরু হয়।-

ইমাম খোমেনী (র) তাঁর ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির মাধ্যমে কেবল ইরান নয়, পশ্চিম এশিয়া ও গোটা বিশ্বের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন এবং সে অনুযায়ী নিজের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। ১৯৬০ এর দশকের গোঁড়ার দিকে কারারুদ্ধ অবস্থায় ইমামকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনি কাদের সাথে নিয়ে বিপ্লব করতে চান? তিনি এর উত্তরে বলেছিলেন, এখন যারা দোলনায় শুয়ে আছে তারাই হবে একদিন আমার বিপ্লবের হাতিয়ার। বাস্তবে হয়েছিলোও তাই। সে সময়কার শিশুরা যখন তারুণ্যে পৌঁছে, তখন তাদের নিয়েই ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ঘটেছিলো। আর এটিই ছিল ১৫ই খোরদাদ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। সবাইকে জানাচ্ছি আবারও সংগ্রামী সালাম ও শুভেচ্ছা। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।