সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত ৭-১৪ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ২য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম অনুসারে নাজিল হওয়া এই সূরায় মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। অপরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে দাওয়াত করা ঈমানদারদের দায়িত্ব। কিন্তু কাউকে বলপূর্বক ঈমান আনতে বাধ্য করা যাবে না। আজ আমরা এই সূরার ৭ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ৭ থেকে ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
یَا أَیُّهَا الَّذِینَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ یَنْصُرْکُمْ وَیُثَبِّتْ أَقْدَامَکُمْ ﴿٧﴾ وَالَّذِینَ کَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ ﴿٨﴾ ذَلِکَ بِأَنَّهُمْ کَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ﴿٩﴾
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন আর তোমাদের পা-গুলোকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।” (৪৭:৭)
“আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংস [ও মৃত্যু] এবং [আল্লাহ] তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।” (৪৭:৮)
“এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই [আল্লাহ] তাদের আমলসমূহ নিস্ফল করে দিয়েছেন।” (৪৭:৯)
গত আসরে জিহাদের ময়দানে ইসলামের শত্রুদের মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছিল। এরপর আজকের এই তিন আয়াতে মুমিনদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: জিহাদের ময়দানে সংঘাত অনিবার্য এবং সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই ধর্ম ও দেশ রক্ষা করার জন্য সেখানে তোমাদেরকে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্টা দেখাতে হবে এবং জিহাদের ময়দান থেকে পিছ-পা হওয়া যাবে না।
তোমরা যদি শত্রুর মোকাবিলায় আল্লাহর ধর্ম রক্ষায় দৃঢ়সংকল্প থাকো তাহলে নিশ্চিত থেকো যে, আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা শত্রুদের ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন। তারা ইসলামের শাশ্বত বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে এই দ্বীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। কাজেই তাদের পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়। তারা তাদের কর্মের কাঙ্ক্ষিত ফলও পাবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- শুধুমাত্র মৌখিক ঈমান যথেষ্ট নয় বরং আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে চেষ্টা চালাতে হবে। সমাজকে ধর্মদ্রোহিতার দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন যেকোনো কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
২- স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করার বিষয়টিতে পার্থক্য ঘটে। কখনো সত্য প্রচার করে, কখনো আর্থিক অনুদান দিয়ে আবার কখনো বা নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এ কাজ করতে হয়।
৩- ঐশী শিক্ষার প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা কুফরির শামিল। অন্তরের এই কুফরির কারণে মানুষের সব ভালো কাজ ধ্বংস হয়ে যায়।
৪- সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধ্বংস। কেউ সত্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিলে জীবনের বিপদসঙ্কুল বাঁকগুলোতে তাকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না।
সূরা মুহাম্মাদের ১০ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَلَمْ یَسِیرُوا فِی الأرْضِ فَیَنْظُرُوا کَیْفَ کَانَ عَاقِبَةُ الَّذِینَ مِنْ قَبْلِهِمْ دَمَّرَ اللَّهُ عَلَیْهِمْ وَلِلْکَافِرِینَ أَمْثَالُهَا ﴿١٠﴾ ذَلِکَ بِأَنَّ اللَّهَ مَوْلَى الَّذِینَ آمَنُوا وَأَنَّ الْکَافِرِینَ لا مَوْلَى لَهُمْ ﴿١١﴾
“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি এবং দেখেনি যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। আর এই অবিশ্বাসীদের জন্যও রয়েছে অনুরূপ পরিণাম।”(৪৭:১০)
“এটা এজন্যে যে, নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক এবং নিশ্চয় কাফিরদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।” (৪৭:১১)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণকারী কাফির ও মুশরিকদের সতর্ক করে বলা হচ্ছে, যদি তোমরা ভ্রমণে বের হও এবং এ সময় চারদিকে ভালো করে তাকাও তাহলে অতীত জাতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ তোমাদের চোখে পড়বে। এগুলো দেখে চিন্তা করো যে, তারা এমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের নাম নেয়ার মতো কোনো মানুষ আর পৃথিবীতে নেই। তোমরা ভেবো না যে, এই পরিণতি শুধু তাদের কপালেই লেখা ছিল এবং তোমাদের এমন পরিণতি হবে না। তোমরাও যদি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করো তাহলে তোমাদের ভাগ্যেও এমন পরিণতি জুটবে এবং তোমরাও সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিলে বিশ্বজগতে তোমাদেরকে রক্ষা করার মতো আর কোনো শক্তি থাকবে না।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- ইসলামে অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করে ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
২- কাফিরদের ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য যেন আমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে। পার্থিব জগতে আরাম-আয়েশে থাকলেও পরকালে তারা কিছুই পাবে না।
৩- আল্লাহর প্রতি ঈমান দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়ার মাধ্যম। আর কুফর হচ্ছে এসব কিছু হারানোর অনুষঙ্গ।
সূরা মুহাম্মাদের ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِنَّ اللَّهَ یُدْخِلُ الَّذِینَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِی مِنْ تَحْتِهَا الأنْهَارُ وَالَّذِینَ کَفَرُوا یَتَمَتَّعُونَ وَیَأْکُلُونَ کَمَا تَأْکُلُ الأنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ ﴿١٢﴾
“যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই [জান্নাতের] উদ্যানে প্রবেশ করাবেন, যার [গাছপালার] তলদেশে নদীমালা প্রবাহিত। কিন্তু যারা অবিশ্বাস করে, তারা সারাক্ষণ [ক্ষণিকের] ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে এবং জন্তু-জানোয়ারের মত উদর-পূর্তি করে। আর [পরিণতিতে] তাদের নিবাস হল জাহান্নাম।” (৪৭:১২)
পার্থিব জগতে মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে তুলনা করার পর এই আয়াতে পরকালে এই দুই শ্রেণির মানুষের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, মুমিন ব্যক্তিরা পার্থিব জীবনে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং সাধ্যমতো সৎকাজ করার কারণে পরকালে তাদেরকে অফুরন্ত নেয়ামতে পরিপূর্ণ সবুজ-শ্যামল উদ্যানে রাখা হবে। পক্ষান্তরে যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের স্থায়ী নিবাস হবে জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নি। কারণ, তারা পার্থিব জীবনে ক্ষণিকের ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছিল। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো উদরপূর্তি ও কামনা চরিতার্থ করায় লিপ্ত ছিল এবং পরকালের জন্য কোনো পুঁজি সঞ্চয় করেনি।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পৃথিবীর জীবনের যেকোনো সাফল্যের স্থায়ীত্ব অল্প দিনের, সে সাফল্য কম হোক বা বেশি। কাজেই আমাদেরকে পরকালীন পুঁজি সঞ্চয়ে বেশি মনযোগী হতে হবে।
২- পবিত্র কুরআন পার্থিব জীবনকে উপভোগ করতে নিষেধ করেনি কিন্তু পশুর মতো জীবনযাপনের বিরোধিতা করেছে।
৩- জীবনের চলার পথ নির্ধারণের আগে চিরস্থায়ী আবাসের কথা মাথায় রাখতে হবে। আমাদেরকে গন্তব্যের কথা ভাবতে হবে। সড়কের দু’পাশে থাকা মনোরম সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হলে চলবে না।
সূরা মুহাম্মাদের ১৩ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَکَأَیِّنْ مِنْ قَرْیَةٍ هِیَ أَشَدُّ قُوَّةً مِنْ قَرْیَتِکَ الَّتِی أَخْرَجَتْکَ أَهْلَکْنَاهُمْ فَلا نَاصِرَ لَهُمْ ﴿١٣﴾ أَفَمَنْ کَانَ عَلَى بَیِّنَةٍ مِنْ رَبِّهِ کَمَنْ زُیِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ ﴿١٤﴾
“আর তারা যে জনপদ হতে আপনাকে বিতাড়িত করেছে তা অপেক্ষা অতি শক্তিশালী কত জনপদ ছিল; আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।” (৪৭:১৩)
“সুতরাং, যে ব্যক্তি তার রব প্রেরিত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি তার ন্যায় যার কাছে নিজের মন্দ কাজগুলো শোভন করে দেয়া হয়েছে এবং যারা নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে?” (৪৭:১৪)
এই দুই আয়াতে কাফিরদের কুৎসিত চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তারা তাদের সম্পদ ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে পড়েছে এবং তারা ভাবছে তাদেরকে পরাভূত করার মতো কেউ নেই। অথচ অতীত জাতিগুলোর পরিণতি প্রমাণ করছে যে, তারা আল্লাহর ইচ্ছায় ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার কেউ ছিল না। কাফিরদের আরেকটি মারাত্মক ত্রুটি হচ্ছে তারা ঋপুর তাড়নায় সাড়া দেয়া ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে এতটা ব্যস্ত থাকে যে, এর পরিণতিতে তাদের খারাপ কাজগুলো তাদের চোখে শোভনীয় মনে হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সত্য তাদের দৃষ্টিতে কুৎসিত মনে হয় বলে তারা তা মেনে নিতে অস্বীকার করে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- শত্রুর বাহ্যিক চাকচিক্য ও দম্ভ দেখে যেন মুমিন ভয় না পায়। কারণ, আল্লাহর ক্ষমতা মানুষের ক্ষমতার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে।
২- শত্রুরা নানা উপায়ে মুমিনদের কষ্ট দেয়। কিন্তু তাই বলে প্রকৃত মুমিন কখনো ঈমানের পথ ত্যাগ করে না বরং চেষ্টা ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
৩- ঈমানের ভিত্তি হচ্ছে দলিল ও যুক্তি। কিন্তু কুফরের ভরসা হচ্ছে প্রবৃত্তির তাড়না ও ভ্রান্ত ধারণা।
৪- আল্লাহর দেয়া বিবেক কাজে লাগালে মানুষ নিজের খারাপ কাজের কদর্য অনুভব করে। কিন্তু প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানোর জন্য সে বিবেকের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে নানারকম ভ্রান্ত যুক্তি দাঁড় করিয়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। এভাবে এক সময় খারাপ কাজগুলো মানুষের চোখে সুন্দর হয়ে ধরা দেয়। #
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।