ডিসেম্বর ০৫, ২০২১ ১৯:০৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৭ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২৯ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 أَمْ حَسِبَ الَّذِینَ فِی قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ یُخْرِجَ اللَّهُ أَضْغَانَهُمْ ﴿٢٩﴾ وَلَوْ نَشَاءُ لأرَیْنَاکَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِیمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِی لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللَّهُ یَعْلَمُ أَعْمَالَکُمْ ﴿٣٠﴾

“যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা কি ভেবেছে যে, আল্লাহ্‌ কখনো তাদের [অন্তরের] বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দেবেন না?”  (৪৭:২৯)

“আর আমি ইচ্ছে করলে আপনাকে তাদের পরিচয় দিতে পারি; সেক্ষেত্রে আপনি তাদের মুখ দেখে তাদেরকে চিনতে পারবেন এবং কথার ভঙ্গিতে তাদেরকে চিনতে পারবেন। আর আল্লাহ্‌ তোমাদের যাবতীয় আমল সম্পর্কে জানেন।”  (৪৭:৩০)

গত আসরে সেইসব মুনাফিকের কথা বলা হয়েছিল যারা আল্লাহর নির্দেশ পালনের পরিবর্তে নিজেদের এমন সব খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। এই দুই আয়াতে তাদের আরেকটি লক্ষণের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: তারা অন্তরে আল্লাহর রাসূল (সা.) ও মুমিনদের সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করে।  তারা মুখে ঈমানের দাবি করে এবং মুমিনদের সঙ্গে ওঠাবসা করে ঠিকই কিন্তু নিজেদের পার্থিব ও বস্তুগত স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে গোপনে শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলায়। তারা কাফিরদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার পরিবর্তে মুমিনদের অবস্থান দুর্বল করতে কাফিরদের সহযোগিতা করে। 

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তিনি চাইলে এসব মুনাফিকের চেহারায় এমন লক্ষণ ফুটিয়ে তুলতে পারেন যা দেখে সবাই তাদেরকে চিনতে পারে। কিন্তু পার্থিব জীবনে মানুষের অন্তরের রোগ চেহারায় ফুটিয়ে তোলা আল্লাহর রীতি নয়। তবে প্রজ্ঞাবান মুমিনগণ মুনাফিকদের কথাবার্তা শুনেই তাদের অন্তরের রোগ ধরে ফেলতে পারতেন।

যেমন- জিহাদের ডাক আসলে এসব মানুষ হতাশার বাণী শুনিয়ে মুমিনদেরকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করত। অথবা তারা শত্রুদের শক্তিমত্তাকে এতটা বড় করে তুলে ধরত যাতে মুমিনরা যুদ্ধে যেতে ভয় পান। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তারা যেন না ভাবে তাদের অন্তরের রোগ সম্পর্কে আল্লাহও উদাসীন। বরং আল্লাহ তাদের প্রতিটি পদচারণা নখদর্পনে রেখেছেন এবং সময়মতো তাদেরকে শাস্তি দেবেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আমাদেরকে আমাদের অন্তরের সম্ভাব্য নিফাকি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যেন একথা না ভাবি যে, আমাদের অন্তরের খারাপ চিন্তা ও বদ উদ্দেশ্য চিরকাল লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

২- হিংসা ও বিদ্বেষ হচ্ছে অন্তরে নিফাক ও কপটতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ। আমরা যেন কোনো অবস্থায় ঈমানদার ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ না করি। কারণ, এটি মুনাফিকদের চরিত্রিক ত্রুটি।

৩- মানুষের মুখায়বে তার অন্তরের চিন্তাভাবনা পরিস্ফুট হয়। মানুষ অন্তরে কি চিন্তা করে তা সে লুকিয়ে রাখার যত চেষ্টাই করুক না কেন তার চেহারা দেখলে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়।

সূরা মুহাম্মাদের ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَنَبْلُوَنَّکُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِینَ مِنْکُمْ وَالصَّابِرِینَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَکُمْ ﴿٣١﴾

“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই [ও স্পষ্ট করে দেই] এবং তোমাদের কার্যাবলী পরীক্ষা করি।”(৪৭:৩১)

এই আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার একটি সুন্নত বা রীতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: ঈমানের দাবিদারদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এসব দাবিদারদের মধ্যে কারা আসল ও কারা নকল তা স্পষ্ট করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নানা ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। যারা বিপদে পড়লে দ্বীন ও ঈমান পরিত্যাগ করে চলে যায় তাদের থেকে যারা কঠিনতম দুঃসময়েও নিজেদের ঈমান রক্ষা করেন তাদেরকে আলাদা করার জন্যই এ পরীক্ষা।

স্বাভাবিকভাবে যারা মুনাফিক ও অন্তরে অপটতা পোষণ করে কঠিন বিপদের দিনে তাদের পক্ষে নিজেদের অন্তরের অবস্থা গোপন করে রাখা সম্ভব হয় না। এ সময়ে তারা এমন সব কাজ করে বসে যাতে তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায় এবং সবাই তাদেরকে চিনে ফেলে। আর আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন এসব মানুষকে অন্যদের সামনে স্পষ্ট করার জন্যই। কারণ, আল্লাহর চেনার জন্য তো পরীক্ষা করার দরকার হয় না। তিনি অন্তর্যামী, তিনি অন্তরের সব খবর রাখেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- ঈমানের দাবিদাররা যেন নিজেরা তাদের ঈমান পরিমাপ করতে পারে এবং অন্যরাও যাতে তাদেরকে চিনতে পারে সেজন্য আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের মানুষকে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রেখেছেন।

২- দ্বীনের রাস্তায় কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকা প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক।

৩- বিপদ-আপদ ও সংকটে ঈমান রক্ষা করাই প্রকৃত ঈমানের মাপকাঠি। তা না হলে সুখে-শান্তিতে থাকা অবস্থায় যে কেউ ঈমানদার হওয়ার দাবি করতে পারে।

সূরা মুহাম্মাদের ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 إِنَّ الَّذِینَ کَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِیلِ اللَّهِ وَشَاقُّوا الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمُ الْهُدَى لَنْ یَضُرُّوا اللَّهَ شَیْئًا وَسَیُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ ﴿٣٢﴾

“নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে ও [মানুষকে] আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করেছে এবং নিজেদের কাছে হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর রাসূলের বিরোধিতা করেছে, তারা আল্লাহ্‌র কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর অচিরেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিস্ফল করে দেবেন।” (৪৭:৩২)

আগের কয়েকটি আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্র উন্মোচন করার পর এই আয়াতে একটি মূলনীতি বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: যেসব কাফের প্রকাশ্যে নিজেদের কুফরের কথা স্বীকার করেছে এবং যেসব মুনাফিক নিজেদের কুফরের কথা গোপন রেখেছে তাদের সবাই আল্লাহ ও তার রাসূলের ব্যাপারে অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করে।  তাদের সামনে সত্য স্পষ্ট এবং তারা রাসূলের আনীত ধর্মকে সঠিক ও সত্য বলে উপলব্ধি করে। কিন্তু তারপরও তাদের অন্তর এই ধর্মের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষে পূর্ণ। তারা ভাবে তারা সুযোগ পেলেই দ্বীন ইসলামের চরম ক্ষতি করতে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার স্তব্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা হচ্ছে, ইসলামের সমুজ্জ্বল শিখা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ুক এবং কুফর ও নিফাক ধ্বংস হয়ে যাক।

এই আয়াত থেকে আমরা যেসব বিষয় শিখতে পারি তার কয়েকটি হচ্ছে:

১- সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণের অনিবার্য পরিণতি ধ্বংস।

২- আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য হেদায়েতের উপকরণ পাঠিয়েছেন এবং তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। কাজেই মানুষের উচিত সত্যকে উপলব্ধি করে তা অনুসরণ করা।

৩- কাফির ও মুশরিকদের ইসলাম বিদ্বেষী ষড়যন্ত্র সফল হয় না বরং আল্লাহর পাঠানো ধর্ম ইসলাম দিনকে দিন সমৃদ্ধি লাভ করে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ