ডিসেম্বর ০৫, ২০২১ ১৯:১৭ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৭ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

یَا أَیُّهَا الَّذِینَ آمَنُوا أَطِیعُوا اللَّهَ وَأَطِیعُوا الرَّسُولَ وَلا تُبْطِلُوا أَعْمَالَکُمْ ﴿٣٣﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমরা [আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করার মাধ্যমে] তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না।”  (৪৭:৩৩)

গত আসরে মুনাফিক ও কাফিরদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। আর আজকের এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উদ্দেশ করে বলছেন, হে মুমিনগণ‍! তোমরা সতর্ক থেকো। মুনাফিকদের মতো তোমরাও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানি করে বসো না। মুনাফিকরা মুখে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু বাস্তব জীবনে এসব নির্দেশের বিরোধিতা করে অথবা নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য ঠিকমতো পালন করে না।

কিন্তু তোমরা যারা নিজেদেরকে খাঁটি মুমিন বলে দাবি করো এবং নিজেদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী বলে মনে করো তোমাদেরকে বাস্তব জীবনে একথার প্রমাণ দিতে হবে যে, সত্যিকার অর্থেই তোমরা আল্লাহর অনুগত রয়েছ। তোমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তোমরা তোমাদের অন্তরের খেয়ালখুশি অনুযায়ী নয় বরং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করো।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- ঈমানের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্যকারী ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবি করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

২- পবিত্র কুরআনের বিধানাবলীর পাশাপাশি রাসূলের সুন্নতও অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কাজেই দ্বীন শিখতে হলে আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ উভয়ের প্রতি মনযোগী হতে হবে।

৩- শুধুমাত্র নেক আমল করাই যথেষ্ট নয়; সেইসঙ্গে এই আমল হতে হবে শিরক, রিয়া ও অহংকারমুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নেক আমল করা যাবে না।

সূরা মুহাম্মাদের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 إِنَّ الَّذِینَ کَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِیلِ اللَّهِ ثُمَّ مَاتُوا وَهُمْ کُفَّارٌ فَلَنْ یَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ ﴿٣٤﴾ 

 “নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে [মানুষকে] নিবৃত্ত করেছে, তারপর কাফির অবস্থায় মারা গেছে, আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না।”(৪৭:৩৪)

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজেকে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি তাঁর বান্দাদের অসংখ্য-অগণিত গোনাহ ক্ষমা করে দেন। কিন্তু একশ্রেণির মানুষ আছে যারা কুফর ও শিরকের প্রতি অটল থাকে, অপরের জন্য গুনাহ করার উপকরণ প্রস্তুত করে, পাপ করার পথ দেখিয়ে দেয় এবং আমৃত্যু এই কাজে অবিচল থাকে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, এ ধরনের মানুষের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা প্রযোজ্য হবে না এবং তাদেরকে কোনো অবস্থায় ক্ষমা করা হবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মহান আল্লাহ তওবা করে তাঁর দিকে ফিরে আসার পথ সবার সামনে উন্মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু যারা কুফরি ও শিরক করে এবং আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচরণে অটল-অবিচল থাকে এবং এই অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয় তারা আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হবে।

২- মৃত্যুর সময় মানুষ মুমিন নাকি কাফির অবস্থায় মারা যায় সেটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, এর উপর তার পারলৌকিক ভাগ্য নির্ভর করছে।

৩- আল্লাহর সঙ্গে গোয়ার্তুমি ও অহংকার থেকে যে কুফরি করা হয় তা অত্যন্ত বিপজ্জনক।  কারণ, এই কুফরি মানুষকে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে।

সূরা মুহাম্মাদের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 فَلا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الأعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَکُمْ وَلَنْ یَتِرَکُمْ أَعْمَالَکُمْ ﴿٣٥﴾

“অতএব তোমরা হীনবল হয়ো না ও [শত্রুদের প্রতি] সন্ধির আহবান জানিও না এমন অবস্থায় যখন তোমরাই প্রবল। আর আল্লাহ তোমাদের সাথেই রয়েছেন এবং কখনই তিনি তোমাদের কর্মের [প্রতিদান] হ্রাস করবেন না।” (৪৭:৩৫)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে ঈমানদারদের উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন: দুর্বল ঈমানের অধিকারী মানুষদের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে তোমরা শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে আপোষ করে বসো না। শত্রুর সঙ্গে কেবল তখন আপোষ করবে যখন তারা শত্রুতা পরিহার করে তোমাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার দিতে এবং তোমাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু যে শত্রু  সারাক্ষণ তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং দ্বীন ইসলাম ধ্বংস করে দিতে চায় তার সঙ্গে আপোষ করলে তোমাদের হীনমন্যতা প্রকাশ পাবে।

মহান আল্লাহ চান ঈমানদাররা সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করুক। মুমিন ব্যক্তিরা যদি তাদের সংকল্পে অটল থাকে তাহলে আল্লাহ তাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করবেন। কিন্তু যারা ভয়ে বা দুর্বল ঈমানের কারণে কিংবা আয়েশি জীবনযাপন করতে গিয়ে ইসলামের চিরশত্রুর সঙ্গে সন্ধি করতে যায় তারা শুধু অপমানিত ও লাঞ্ছিতই হয়। তারা নিজেদের হাতে নিজেদের সম্মান নষ্ট করে।

এখানে একটি কথা স্পষ্ট; শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হলে সেজন্য মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে তাতে সন্ধির চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। আর আল্লাহর ওপর ঈমান রেখে লাভ-ক্ষতির চিন্তা না করে প্রতিরোধ চালিয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সর্বোত্তম সাহায্য পাওয়া যায়। আর আল্লাহ যাকে সাহায্য করেন পৃথিবীর কোনো শক্তি তার ক্ষতি করতে পারে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- ঈমানদার ব্যক্তিরা নিজেদের সংখ্যা ও যুদ্ধাস্ত্রের স্বল্পতায় জিহাদের ময়দান ত্যাগ করে না। আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত ঈমানদারদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন।

২- আয়েশি জীবন ও অলসতার সঙ্গে ঈমানের কোনো সম্পর্ক নেই।

৩- জিহাদের ময়দানে ঈমানদার ব্যক্তিরা কখনো সন্ধির প্রস্তাব দেয় না। কিন্তু শত্রু  সন্ধির প্রস্তাব দিলে তা গ্রহণ করে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।