ডিসেম্বর ১৫, ২০২১ ১৮:৪২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি প্রযুক্তিগত উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অর্থও পাল্টে যাচ্ছে। গণমাধ্যম ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রভাব মানুষের লাইফ স্টাইলকেও প্রভাবিত করছে।

প্রযুক্তি মানুষের সেবায় নিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের ওপর নিজেকে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে। ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টের তথ্য অনুযায়ী ব্রিটেনে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজারের বেশি। এরপর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে অর্থাৎ এমন ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজারের বেশি। ওই দুই বছর প্রতিদিন গড়ে ২২টি এমন ঘটনা ঘটেছে।

অহরহই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে যে, কিছু লোক একটা টেবিলের চারপাশে বসে খাবার খাচ্ছেন এবং পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করছেন। একে অপরের সঙ্গে মজা করছেন, হাসি-ঠাট্টা করছেন। এর মধ্যেই অথবা একটু নীরবতার সুযোগে একজন তার মোবাইল বা স্মার্ট ফোনটা বের করে একটু চেক করে নিল। কেউই তার মোবাইলে এই ঢুঁ মারাটাকে গুরুত্ব দিল না এবং কিছু বললো না। কারণ এ ধরণের কাজকে সবাই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে। এ ধরণের কাজ অন্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। যেকোনো আড্ডায় একজন স্মার্ট ফোনে ঢুঁ মারলেই অন্যরাও এই কাজ করার উৎসাহবোধ করে, প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এভাবে একের পর এক স্মার্টফোন হাতে নিতে থাকে প্রত্যেকেই। আর এক পর্যায়ে আড্ডায় নেমে আসে নীরবতা, সবার মনোযোগ চলে যায় স্মার্ট ফোনে। তখন তারা ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। কেবল আপনার হাতেই মোবাইল নেই। আপনি শুধু তাকিয়ে তাদের অবস্থা দেখছেন। সময়ে, অসময়ে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে মনের অজান্তেই ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতে ঢুঁ মারা এখন সবার নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে। ফলে বাস্তব দুনিয়া থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। 

এখন পারিবারিক প্রণোচ্ছল আড্ডাও কমে গেছে। বন্ধু বান্ধবের দল একত্রিত হলেও তাদের আড্ডা ঘিরে প্রাধান্য পায় সোশ্যাল সাইট ও অনলাইন গেম নিয়ে আলোচনা এবং একটা পর্যায়ে সেই আড্ডাস্থলেই স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। সোশ্যাল মিডিয়ার  মিথ্যে আবেগ বাস্তবজগতে মানুষকে আবেগশূন্য করছে। ইন্টারনেট আসক্তি, সোশ্যাল সাইটগুলোতে অতিরিক্ত চ্যাট মানুষের বাস্তব জীবনের আবেগকে কেড়ে নিচ্ছে। আসলে প্রযুক্তি-নির্ভর পৃথিবী ভাগ হয়ে গিয়েছে বাস্তবে আর ভার্চুয়ালে। যে বাস্তব জগতে আমরা বাস করি, সেখানে যত মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, তার থেকে বহু বেশি মানুষকে আমরা চিনি ও যোগাযোগ রাখি অধরা-অদেখা-কাল্পনিক ভার্চুয়াল জগতে। ভার্চুয়াল ও বাস্তব জগতের আনন্দ আর বেদনা; বিপদ আর সম্ভাবনা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের নিত্যদিনের জীবন ব্যবস্থায়, প্রতিনিদের আচার-আচরণসহ সবকিছুতে। ভার্চুয়াল জগতে পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এই ভাচুয়াল জগতের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মানুষের পরিবর্তিত জীবন পদ্ধতির প্রভাব পড়ছে বাকি বিশ্বের ওপর।

ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল সাইটগুলোতে কোনো স্টেটাস বা পোস্টে এবং মানুষের সামনাসামনি তর্কের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে প্রচুর। দুই জায়গায় মানুষ দু’ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান। ভিন্ন মত পোষণকারীর বক্তব্য সামনাসামনি এক রকম আবার লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন হতে পারে অন্য রকম। তা ছাড়া, ভার্চুয়াল জগতে আমাদের গোপন বলতে কিছু থাকে না। আমাদের নিজেদের অজান্তেই আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, নীতি, বিশ্বাস, আদর্শ, বিতর্কিত চিন্তা ভাবনা, অভ্যাস, অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয় অনেক সময় ব্যক্তিগত থাকে না। যে কোনো সময় ব্যক্তিগত কোনো তথ্যই চলে যেতে পারে অন্যের কাছে। আবার ভার্চুয়াল জগতের সব তথ্যকে সত্য ধরে নিয়ে অনেক সময় বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে এখনও মিথ্যার ছড়াছড়ি। এই জগতের সব কিছুকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করাটা বড় বোকামি। এই জগতে কেউ চাইলে কল্পনার ওপর ভিত্তি করে একটা ভিন্নধর্মী জীবন সাজিয়ে নিতে পারে, বাস্তবে যার কোনো ধরণের অস্তিত্বই নেই। এর ফলে অনেকের জীবনের অস্তিত্ব থাকে শুধু ছবিতে, স্টেটাসে, মেসেজে।

অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বর্তমানে যে ভাবে বিস্তার লাভ করছে, তাতে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। অনেকে আশঙ্কা করছেন একটা পর্যায়ে  মানবতা পুরোপুরি ভার্চুয়াল জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে মানুষের পরস্পরের মধ্যে বাস্তবতা ভিত্তিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক হ্রাস পাবে। কিন্তু মানুষ সব সময় কল্পনার জগতে বাস করতে পারে না। মানুষকে একটা পর্যায়ে কল্পনার জগত থেকে বের হতেই হবে। কিন্তু যখনি তারা এই জগত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসবে তখনি নিজেকে একা অনুভব করতে থাকবে। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে আধুনিক একাকীত্ব হিসেবে অভিহিত করেছেন।  গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন হলে তা অনেকের জন্য মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া, টেকনোলজি অ্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টার পরিচালিত দেশব্যাপী এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, যেসব তরুণ ৭টি থেকে ১১টি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাদের তুলনায় যারা মাত্র দুটি ব্যবহার করে তারা হতাশা ও অবসাদে কম আক্রান্ত হন। এতে দেখা যাচ্ছে কম সংখ্যক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের তুলনায় বেশি সংখ্যক নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীরা তিন গুণ বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এই গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ব্রায়ান এ. প্রাইমেক মনে করেন, বেশি সংখ্যক সোশ্যাল সাইট ব্যবহারের সঙ্গে মানুষের হতাশা ও অবসাদের সম্পর্ক এতটাই স্পষ্ট যে চিকিৎসকরা এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সোশ্যাল সাইটগুলোর প্রভাব বিবেচনায় নিতে পারেন। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ