সুখের নীড়- পর্ব ১
ভাই ও বোনেরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। ইসলামী ও ইরানি পরিবার বিষয়ক নতুন ধারাবাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান সুখের নীড় থেকে আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি সাদর সম্ভাষণ ও আমাদের সঙ্গী হবার একান্ত আমন্ত্রণ।
পৃথিবীটা এখনও হয়ে যায়নি পুরোপুরি যান্ত্রিক কিংবা আত্মাহীন নিষ্প্রাণ
যদিও হয়েছে তা বৈশ্বিক গ্রাম, কখনও ঠুনকো আঘাতেই কাঁচের মত খান্খান্
যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির সুবাদে বিশ্ব-সমাজ যেন এক ছোট পরিবার
যদিও প্রতিনিয়ত চলছে তথ্যের অবাধ বিস্ফোরণ! চক্ষু চড়ক গাছ আকর্ষণ-বিকর্ষণ!
অজস্র ব্যবসায়িক প্রচারণার বোমা-বর্ষণে দিশেহারা লক্ষ কোটি প্রাণ
তবুও আজো শেষ হয়ে যায়নি মানবপ্রেম, হৃদয়বৃত্তি, আন্তরিকতা
আজও হয়নি শেষ কিছু পুরনো প্রথা, শাশ্বত ঐতিহ্য, সুপ্রাচীন কত ভাবধারা
মানুষের জন্য মানুষের হৃদয়ে আজও বয়ে চলে স্নেহের ফল্গুধারা
আজও ভালো লাগে পবিত্র হৃদয়গুলোর প্রেমের মধুর টান
সমাজের প্রাণকেন্দ্র জুড়ে আজো টিকে আছে, টিকে থাক চির-অটুট হয়ে অনির্বার
ভাইবোন স্বামী-স্ত্রী ও প্রিয়জন নিয়ে ধরণীর স্বর্গ-সুখের নীড় সুখী পরিবার!
পরিবার হচ্ছে স্নেহ-মমতার এক অনন্য নীড় এবং সমাজের সুখ শান্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি । বিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে এক পবিত্র চুক্তি ও সামাজিক বন্ধনের সেতু। সন্তান এই বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। পরিবার হচ্ছে সামাজিক জীবনের ভিত্তি। পরিবারগুলো যে সমাজকে কেবল নতুন মানব প্রজন্ম উপহার দেয় তা-ই নয় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও রাখে ব্যাপক ভূমিকা। পরিবারগুলো হচ্ছে নানা প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিনিময় ও সম্প্রচার করার এবং ধরে রাখার মাধ্যম। খাবার গ্রহণের প্রথা থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান পরিবারের মধ্যেই গড়ে ওঠে। পরিবারগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে দেয়। সমাজকে সুস্থ রাখতে হলে পরিবারগুলোকে মানসিক দিকসহ সব দিকে সুস্থ রাখতে হবে। মানবজাতির যত অগ্রগতি ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা ঘটেছে সমৃদ্ধ ও সুস্থ পরিবার থাকার কল্যাণেই। সমৃদ্ধ ও সুস্থ পরিবার না থাকলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক প্রচেষ্টাই হয়ে পড়ে নিষ্ফল।
মানুষ নিজ পরিবারের মধ্যেই আত্ম-পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব গড়ার অনুপ্রেরণা পায়। মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পূর্ণতা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল পরিবার। মোট কথা সুস্থ পরিবার হল প্রশান্তি ও উন্নতির সোপান। পরিবার যদি সুশিক্ষিত হয় তাহলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির পথ সুগম হয় এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধেরও বিকাশ ঘটে।
তাই পরিবার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গেছেন সব নবী-রাসুল। ইসলাম ধর্ম পরিবারকে শক্তিশালী করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হল দয়া ও ভালবাসার কেন্দ্র। পরিবার যদি উন্নত না হয় সমাজও উন্নত হয় না। মানুষের স্নেহ-মমতার চাহিদাসহ আধ্যাত্মিক ও অন্য অনেক চাহিদা মেটানো পরিবারের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
পাশ্চাত্য ও অন্য অনেক দেশের বিপরীতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে পরিবার-ব্যবস্থা বিরোধী শ্লোগানের কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি। ইরানের ভেতর থেকে এমন আহ্বানও শোনা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইরানিরা পরিবারমুখী। ইরানি সমাজে পরিবার এখনও সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। ইরানি পরিবারগুলো এখন আর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর মত পুরনো প্রথাগুলোর অনুসারী নয় সব ক্ষেত্রে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব পরিবার পূর্ণতা ও আদর্শ অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিবারগুলো বড় হয়ে ওঠার আগে যখন ছোট থাকে তখন এর তৎপরতাও থাকে কম এবং বাবা-মায়ের ওপর দায়িত্বও থাকে কম। কিন্তু পরিবারগুলো যখন বড় হয়ে ওঠে তখন তা সামাজিক জীবনে প্রবেশ করে এবং পরিবারের সদস্যদের তৎপরতা ও দায়িত্বও বেড়ে যায়। পরিবার সমাজের প্রধান প্রতিষ্ঠান। ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতির পাশাপাশি এটিও গড়ে ওঠে ও বিস্তার লাভ করে সমাজে।
সমাজ যতই পুরনো ও বিস্তার লাভ করতে থাকে ততই পরিবারের সদস্যরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হতে থাকেন। ব্যক্তির সব ধরনের চাহিদা ও ইচ্ছাগুলো পূরণ করে পরিবার। এভাবে পরিবারও বড় হতে থাকে।
ইরানি পরিবারগুলো ছিল একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শ। পরিবারের সদস্যরা বিয়ে করার পরও একইসঙ্গে একই ভবনে বসবাস করত। সে যুগে ছিল না জাঁকজমক ও ছিল না বড় পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা। দাদা-দাদী, চাচা-চাচী ও দ্বিতীয় প্রজন্মের সবাই একই ভবনে বসবাস করত। এসব পরিবার ছিল সামাজিক যোগাযোগের এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্র। ইরানে কর্ম তৎপরতাও চলত পারিবারকে ঘিরে। সামাজিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলত পরিবারের ভিত্তি। বাবা ও মা হতেন পরিবারের প্রধান। সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনি এরা সবাই অনুগত থাকত বাবা ও মায়ের। বাবা-মা বার্ধক্যের কারণে পরিবারকে নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হলে সেই দায়িত্ব পালন করত পরিবারের সবচেয়ে বড় পুত্র। বিয়ের পর কন্যা সন্তানরা শশুর বাড়িতে যেত। আর পুত্ররা সাধারণত বাবার পেশাই গ্রহণ করত।
৭৫ বছর বয়স্ক জনাব মাশহাদি কাসেম ইরানের আরাক অঞ্চলের অধিবাসী। ইরানের মধ্যাঞ্চল বা কেন্দ্রীয় প্রদেশ হিসেবে খ্যাত এই প্রদেশের একটি গ্রামে তিনি সাত পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বসবাস করেছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা এখন আর পিত্রালয়ে থাকেন না। পুত্ররা পিতার বিশাল ভবনে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সুখেই বসবাস করছেন। ভবনটির মাঝখানে রয়েছে এক বিশাল উঠান। গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হন ও সবার পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। পরিবারের মহিলারা পুরুষদের কাজে ও অর্থনৈতিক তৎপরতায়ও সহায়তা দেন। পরিবারের ঘরোয়া বিষয়গুলো মূলত প্রধান গৃহকর্তৃীর নেতৃত্বেই সুসম্পন্ন হয়। পরিবারের পুত্র সন্তানরা পিতার বাসভবনের বিশাল অংশ জুড়ে বসবাস করলেও তাদের স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্রতাও রয়েছে। তারা পরিবারের সামগ্রিক নীতিমালা মনে চলেই সন্তান প্রতিপালন ও ব্যক্তিগত জীবন স্বাধীনভাবেই পরিচালনা করছেন।
আমাদের এ ধারাবাহিক আলোচনার আগামী পর্বে আমরা ইরানের ছোট ও আধুনিক পরিবারগুলো নিয়ে কথা বলব। আলোচনা শেষ করব পারিবারিক জীবনের সুখ ও সৌভাগ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের দিকে লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানিয়ে। আর তা হল সেসব পরিবারই সুখী যেসব পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং পরস্পরের রুচি ও জীবনসঙ্গীর পরিবারের পূর্ববর্তী অভ্যাস ও পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকে।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।