ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২ ১৫:৪৫ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ২য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ৫ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর সূরা ফাতহ নাজিল হয়। ওই বছর বিশ্বনবী (সা.) ও মদিনার মুসলমানদের একটি বিশাল অংশ ওমরাহ করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মুশরিকরা মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে মুসলিম কাফেলার গতিরোধ করে এবং মক্কায় প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সূরার ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

لِّيُدۡخِلَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا وَيُكَفِّرَ عَنۡهُمۡ سَيِّ‍َٔاتِهِمۡۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عِندَ ٱللَّهِ فَوۡزًا عَظِيمٗا (5)

“যাতে আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে প্রবেশ করান জান্নাতে, যার [গাছের] নীচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং তিনি তাদের পাপসমূহ ঢেকে রাখবেন; আর এটাই আল্লাহর নিকট মহাসাফল্য।” (৪৮:০৫)

গত আসরে মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)-এর স্বাক্ষরিত হুদায়বিয়ার সন্ধি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ওই চুক্তিকে মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতে বিজয়ের সুসংবাদ বলে বর্ণনা করেন। ফলে দৃশ্যত অপমানকর ওই চুক্তিতে যারা ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন তারা স্বস্তি পান। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে- যারা সর্বাবস্থায় রাসূলে খোদার সঙ্গে থাকবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে তারা পার্থিব জীবনে প্রশান্তি লাভের পাশাপাশি পরকালে মহাপুরস্কার পাবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভুলভ্রান্তিগুলো মার্জনা করবেন যাতে তারা জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত ভোগ করতে পারে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- যুদ্ধ বা জিহাদের ময়দানে নারীরা সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও তারা যদি তাদের স্বামী ও পুত্রসন্তানদের জিহাদে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয় তাহলে তারাও জিহাদ করার পুরস্কার লাভ করবে।

২- ঈমানদার হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা সব ধরনের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে থাকবে। বরং তারা যখন অনেক বেশি নেক কাজ করবেন তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করবেন এবং তাদেরকে নিজের রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন।

৩- পার্থিব জীবন ও আখেরাত উভয় জগতে সৌভাগ্য অর্জনকে মহাসাফল্য বলা হয়। তা না হলে পার্থিব জগতে বহু কাফিরকেও আল্লাহ অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করার সুযোগ দেন। তবে কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত অনুযায়ী পরকালে কাফিররা কিছুই পাবে না।

সূরা ফাতহ ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 وَيُعَذِّبَ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ وَٱلۡمُشۡرِكَٰتِ ٱلظَّآنِّينَ بِٱللَّهِ ظَنَّ ٱلسَّوۡءِۚ عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۖ وَغَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡ وَلَعَنَهُمۡ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرٗا (6) وَلِلَّهِ جُنُودُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا (7)

“আর যাতে তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী, মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারী যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে শাস্তি দেন। অমঙ্গল চক্ৰ তাদের উপরই আপতিত হয়। আর আল্লাহ তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন, তাদেরকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদেরকে নিজের রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন; আর তাদের জন্য জাহান্নাম প্ৰস্তুত রেখেছেন। আর সেটা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!” (৪৮:০৬)

“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহই মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”  (৪৮:০৭)

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানরা যখন ওমরা করার জন্য মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে মন্দ ধারনা পোষণকারী মুশরিকরা বলাবলি করেছিল, এরা আর প্রাণ নিয়ে মদিনায় ফিরতে পারবে না। হয় তাদেরকে হত্যা করা হবে আর না হয় বন্দি করা হবে। অন্যদিকে মক্কার মুশরিকরাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়েছিল কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে সে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়।

এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মদিনার মুশরিক ও মক্কার কাফিররা মুসলমানদের জন্য যে মন্দ পরিণতির আকাঙ্ক্ষা করেছিল সেই পরিণতির শিকার তারা নিজেরা হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদেরকে ঐশী শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 

যারা মহান আল্লাহর শক্তিমত্তা ও প্রজ্ঞার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করে জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হয় তারা আল্লাহর দয়া ও সাহায্য লাভ করে। ফলে বিজয় তাদেরই হয়। কিন্তু যারা নিজেরা ভয়ে ঘরে বসে থাকে এবং শত্রুর শক্তিমত্তা সম্পর্কে মুসলমানদের ভয় দেখায় তারা ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়। এ ধরনের মানুষ দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগত হাতছাড়া করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এখানে মুমিন পুরুষের পাশাপাশি মুমিন নারীর এবং মুশরিক ও মুনাফিক পুরুষদের পাশাপাশি তাদের নারীদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ইসলামে বৈধ।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করা মুনাফিক ও মুশরিকদের কাজ।

২- কুচক্রি তৎপরতা ও পথভ্রষ্টতায় মুনাফিক ও মুশরিকরা পরস্পরের সহযোগী। এ কারণে এই দুই আয়াতে মুশরিকদের পাশাপাশি মুনাফিকদের মন্দ পরিণতির কথাও তুলে ধরা হয়েছে। মুনাফিক হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যারা মুমিনদের সঙ্গে ওঠাবসা করে এবং বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।

৩- বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তু আল্লাহ তায়ালার হুকুমের গোলাম। কাজেই যারা আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে পরাজিত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।

সূরা ফাতহ ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ شَٰهِدٗا وَمُبَشِّرٗا وَنَذِيرٗا (8) لِّتُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُۚ وَتُسَبِّحُوهُ بُكۡرَةٗ وَأَصِيلًا (9)

“[হে রাসূল] নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি [কর্মের] সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে।”  (৪৮:০৮)

“যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তাকে সাহায্য কর ও সম্মান কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।” (৪৮:০৯)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মানুষের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের অবস্থান ও মর্যাদা তুলে ধরে বলা হচ্ছে: সমাজে যা কিছু ঘটছে তিনি তার সাক্ষী এবং তার কাছে কোনো কিছু গোপন নেই। তিনি হয়তো যা কিছু জানেন তার সবকিছু বলেন না। এছাড়া, তিনি মানুষকে নেক কাজ করার আহ্বান জানান এবং অপবিত্র ও কুৎসিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের সুসংবাদ দেন এবং মন্দ কাজের নির্মম পরিণতির ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে দেন।

কাজেই ঈমানদার মানুষেরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে বলেই আশা করা যায়। এসব মানুষ কার্যত আল্লাহর রাসূলের সহযোগী হবেন এবং তার মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন যাতে অভ্যন্তরীণ মুনাফিকদের পাশাপাশি বহিঃশত্রুরা তাঁর কোনো ক্ষতি করার সাহস না পায়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষকে দ্বীনের পথে হেদায়েতের আহ্বান জানাতে গেলে সুসংবাদ ও সতর্কবাণীর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে যাতে মানুষ অহংকারী কিংবা হতাশ হয়ে না যায়।

২- সমাজে দ্বীন প্রচারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদেরকে কথা ও কাজে অনুসরণীয় ও আদর্শস্থানীয় হতে হবে। একইসঙ্গে সমাজের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।

৩- আল্লাহর প্রতি ঈমানের পূর্বশর্ত হচ্ছে দ্বীন ও রাসূলে আকরাম (সা.)-এর প্রতি সমর্থন ও তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সমাজে তাঁর অবস্থানকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা।

৪- একজন মুমিন ব্যক্তি তার দৈনন্দিন অন্য সব কাজের পাশাপাশি সকাল ও সন্ধ্যায় নামাজে বা নামাজের বাইরে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক শক্তিশালী করবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।