সিস্তান ও বেলুচিস্তানের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
গত কয়েকটি আসর থেকে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানকার সবচেয়ে বড়ো প্রদেশ সিস্তান ও বেলুচিস্তান। বলেছিলাম যে নাম থেকেই বোঝা যায় প্রদেশটি দুটি ভাগে বিভক্ত।
একটি সিস্তান এবং অপরটি বেলুচিস্তান। এরিমধ্যে আমরা সিস্তানের কয়েকটি শহরের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। গত আসরেই আমরা গিয়েছিলাম দাহনে গোলামন শহরে। এই শহরের স্থাপনার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও আমাদের কমবেশি পরিচয় ঘটেছে। দাহনে গোলামন শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নির্দশন ঐতিহাসিক প্রার্থনালয়গুলো।
যাই হোক জাহেদান থেকে জাবোল যাওয়ার পথে আমরা আমাদের যাত্রার শেষ প্রান্তে গিয়ে আসরের পরিসমাপ্তি টেনেছিলাম। তবে গত আসরেই কথা দিয়েছিলাম যে, আমরা সিস্তান এবং বালুচিস্তান প্রদেশের জাবুল শহরের দিকে যাবো আজ এবং ওই শহরের দর্শনীয় স্থানগুলির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। কথা অনুযায়ী চলে যাওয়া যাক জাবোল শহরে। ঘুরে ফিরে দেখা যাক এই শহরের নান্দনিক সৌন্দর্য ও দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনাগুলো। সেইসঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো এখানকার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে।
যাবোল সিস্তান ও বেলুচিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি শহর। এই শহরের উত্তরে রয়েছে নিমরুজ শহর, পূর্বদিকে হিরমান্দ শহর, দক্ষিণে রয়েছে হামুন ও জাহাক শহর এবং পশ্চিত দিকে হামুন শহর অবস্থিত। এই এলাকাটি আগেকার দিনে সাকাস্তান কিংবা নিমরুজ নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শ পঁয়ত্রিশ খ্রিষ্টাব্দে যাবোল নামে অভিহিত হয় এবং তার পর থেকে এই যাবোল নামই ধারণ করে আছে শহরটি। মহাকবি ফেরদৌসির বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামাতেও এই শহরটিকে যাবোলেস্তান নামে উল্লেখ করা হয়েছে। শাহনামার অসংখ্য গল্পের সূতিকাগার এই যাবোল শহর। বিশেষ করে শাহনামার বিখ্যাত কিছু চরিত্র যেমন রূপকথার মহাবীর সাম, যাল এবং রুস্তমের যে বর্ণনা এসেছে সেসব বর্ণনা এই যাবোলকে ঘিরেই করা হয়েছে। ফেরদৌসির শাহনামায় বহুবার যাবোলেস্তান শহরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই যাবোল ইরানের ঐতিহাসিক দুই ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান। একজন হলেন ইরানের দু:সাহসী কমান্ডার সোরেনা এবং সাফারিয়ান রাজবংশের বিশিষ্ট বাদশাহ ইয়াকুব লিস সাফফারেরও জন্মস্থান। তার মানে যাবোল ভ্রমণ করার অর্থ হলো ইতিহাসের ভূগোলে ভ্রমণ করা। সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালনভূমি এই যাবোল শহরের দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনাগুলো আমরা এক এক করে দেখার চেষ্টা করবো। প্রথমেই যাওয়া যাক যাবোল শহরের ট্র্যাডিশনাল বাজারের দিকে। পুরোণো বাজারে গেলে খুব সহজেই ওই এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে দ্রুত পরিচিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই বাজারের বয়স অবশ্য খুব বেশি নয়, দেড় শ বছরের মতো। বাজারের নাম হলো নাসের উদ্দিন শাহ বাজার। বেশ বড়সড়ো বাজারটি। শত শত দোকান রয়েছে এই বাজারে। এখানকার দর্শনীয় একটি বিষয় হলো লোকজনের পরিধানের জামার বৈচিত্র্য। সিস্তানিদের নিজস্ব ঐতিহ্যের ধারক এইসব জামা।
রঙ-বেরঙের পোশাকে বাজারময় ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর দিকে তাকালেই ভালো লাগবে। এসব পোশাকের বেশিরভাগই হাতে তৈরি করা আবার সুঁই-সূতোর কাজেরও নমুনা সহজেই লক্ষ্য করা যাবে। না কেবল দেখাই নয়, ইচ্ছে করলে আপনি কিনতেও পারবেন এইসব পোশাক। পোশাক আশাক ছাড়াও এই বাজারে কিনতে পাওয়া যাবে বিচিত্র মশলা। আরও পাওয়া সিস্তানের স্থানীয় হস্তশিল্প সামগ্রীও। কেবল কি কেনাকাটা? খাবার দাাবরেরও চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে এই সুন্নতি বা ঐতিহ্যবাহী বাজারে। ঐতিহ্যবাহী বাজারে এলাকার ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবারের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ রয়েছে।
যারা অভিজ্ঞ ভ্রমণকারী বা পর্যটক তাদের ক্ষেত্রে একটা জিনিস লক্ষ্য করা যায়। সেটা হলো তাঁরা যে এলাকাতেই বেড়াতে যান ওই এলাকার স্থানীয় খাবার খেতে চেষ্টা করেন। এর একটা কারণ হলো খাবারের মাধ্যমে একটি এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে উপলব্ধি করা যায়। যাবোল শহরের এরকম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম করতে বলা হলে অবশ্যই যে কটি নাম ক্রমান্বয়ে উচ্চারিত হবে সেগুলো হলো: বোরাক সিস্তানি, কোলোম্পেহ, কুলুচে সিস্তানি এবং স্থানীয় রুটি। যাবোল শহরের আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো এখানকার অ্যানথ্রোপোলজি মিউজিয়াম বা নৃবিজ্ঞান যাদুঘর। এই যাদুঘরটি আগেকার দিনে কিংবা বলা যায় যখন এই শহরটি গড়ে উঠছিল সেই সময় অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশরা তাদের কনস্যুলেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
উনিশ শ ছিয়াশি খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কনস্যুলেট যাবোল শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এরপর দু' হাজার ছয় সালে চূড়ান্তভাবে সিস্তানের নৃবিজ্ঞান যাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রম শুরু করে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির আয়তন তিন হাজার নয় হাজার বায়ান্ন বর্গমিটার। মূল ভবনটি এক হাজার এক শ পঁচিশ বর্গমিটারের ওপর স্থাপিত। ভবনের ছাদ গম্বুজ আকৃতির। ছাদের উপরে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা যেমন রয়েছে তেমনি ভবনের ভেতরের তাপ বের হবারও ব্যবস্থা রয়েছে।
এই যাদুঘরে স্থানীয় বহু মূল্যবান নিদর্শনের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা হয়েছে পোড়া শহরের মূল্যবান বহু সামগ্রীও। এই জাদুঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় একটি সামগ্রী হলো এখানকার একটি মৃৎশিল্প যার ওপর পাহাড়ি ছাগলের নকশা খোদাই করা আছে। এই মৃৎপাত্রটি পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেশন হিসেবে পরিচিত। এই মৃৎপাত্রটি পোড়া শহর খননের সময় পাওয়া গেছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।