ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২ ১৮:১৩ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি আসর থেকে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানকার সবচেয়ে বড়ো প্রদেশ সিস্তান ও বেলুচিস্তান। এরিমধ্যে আমরা সিস্তানের কয়েকটি শহরের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। গত আসরেই আমরা গিয়েছিলাম জাবোল শহরে। এই শহরের স্থাপনার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও আমাদের কমবেশি পরিচয় ঘটেছে।

জাহেদান থেকে জাবোল যাওয়ার পথে পথেও আমরা দেখেছি এই প্রদেশের সৌন্দর্য। সত্যিই দারুণ উপভোগ্য। আমরা জাবোল শহরে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে স্থাপনাটি দেখেছি সেটি হলো ব্রিটিশদের কনস্যুলেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পরবর্তীকালের যাদুঘর।

উনিশ শ ছিয়াশি খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কনস্যুলেট যাবোল শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এরপর দু' হাজার ছয় সালে চূড়ান্তভাবে সিস্তানের নৃবিজ্ঞান যাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রম শুরু করে। আরও দেখেছি যাবোল শহরের ট্র্যাডিশনাল বাজার। পুরনো বাজারে গেলে খুব সহজেই সংশ্লিষ্ট এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে দ্রুত পরিচিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাজারের নাম হলো নাসের উদ্দিন শাহ বাজার। এই বাজারের দর্শনীয় একটি বিষয় ছিলো লোকজনের পরিধানের জামার বৈচিত্র্য। সিস্তানিদের নিজস্ব ঐতিহ্যের ধারক এইসব জামা।

মনে আছে নিশ্চয়ই ব্রিটিশ কনস্যুলেট জাদুঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় একটি সামগ্রী ছিলো একটি মৃৎশিল্প যার ওপর পাহাড়ি ছাগলের নকশা খোদাই করা আছে। এই মৃৎপাত্রটি পৃথিবীর প্রথম অ্যানিমেশন হিসেবে পরিচিত। এই মৃৎপাত্রটি পোড়া শহর খননের সময় পাওয়া গেছে। যাই হোক আমরা আজ যাবোল শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে বেড়াতে যাবো। কূহ খাজা মানে খাজা পাহাড় নামে একটি পাহাড় দেখতে যাবো। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়টি। এই পাহাড়ের আরও একটি নাম আছে: কূহ উশিদা। ফার্সি ভাষায় এর অর্থ হলো চিরন্তন। পর্বতটি কালো বেসাল্ট শিলাময়।  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাহাড়টির উচ্চতা ছয় শ নয় মিটার। এই পাহাড়টিকে হামুন হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপের মতো মনে হয়। জরথুস্তদের সময় এই পাহাড়ে অগ্নিমন্দিরের উপস্থিতি ছিল। যার ফলে প্রার্থনার একটি পবিত্র কেন্দ্র হিসেবে সবার কাছেই সমাদৃত ছিল।

 খাজা গালতনের সমাধি

জরথুস্তদের পরেও এই পাহাড় তার সম্মান ও মর্যাদা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছে। মোটামুটি তিনটি ধর্মের লোকজনের কাছেই এই পাহাড়টির পবিত্রতা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ছিল। জরথুস্তদের কাছে তো বটেই, খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের কাছেও সমানভাবে মর্যাদার আসনে ছিল এই খাজা বা উশিদা পাহাড়। এ কারণেই ইরানিদের মাঝেও এই স্থানটি বেশ সম্মানের বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই পর্বতের চারপাশে শাসানিয়, আশকানিয় এবং ইসলামি যুগের বহু নিদর্শন অবশিষ্ট রয়েছে। এখানকার বৌদ্ধ মন্দিরসহ প্রচুর পুরাকীর্তি এখনও আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে প্রাসাদ কমপ্লেক্স, কাহাক কোহজাদ দুর্গ, চেহেল দোখতার দুর্গ, সারসাং দুর্গ, খাজা গালতনের সমাধি, গান্দুম বিরিয়ন  পীর ভবন, শয়তানের বাড়ি এবং ইসলামী বহু কবর।

খাজা গালতনের সমাধির কথা বলছিলাম। এই সমাধিটি সমগ্র যাবোলের মধ্যে যিয়ারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। এই সমাধিটি খাজা পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থিত। সমাধিটি আয়তক্ষেত্রাকার। একটি খিলান এবং একটি গম্বুজ বিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে এই সমাধি স্থাপনায়। ওই কক্ষে একটি বড় কবর দেখতে পাওয়া যায়। "এহিয়াউল মুলুক" বইতে শাহ হুসাইন সিস্তানি ওই কবরটি নবী দানিয়েলের ভাইয়ের বলে উল্লেখ করেছেন। কবর থেকে আমরা এবার যাবো দুর্গের দিকে। রুস্তম দুর্গ। যাবোল শহর থেকে ষাট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে এই রুস্তম ক্যাসল অবস্থিত। দুর্গটি প্রায় চারশ বছর আগে থেকে পরিত্যক্ত। তবু যে কেউই যাবুলে আসেন তিনি এই ঐতিহাসিক স্থানটি দেখার আগ্রহ দেখান।

এখনও কেল্লাটিতে কোনোরকম খননকাজ করা হয় নি। তবে কেল্লার ভেতর থেকে যেসব প্রাচীন তৈজস ও মৃৎপাত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেসব থেকে এই দুর্গের প্রাচীনত্বের বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। মরুপ্রান্তরে অবস্থিত এই রুস্তম দুর্গ এতোই সুন্দর এবং আকর্ষণীয় যে যে-ই দেখতে যায় মুগ্ধ না হয়ে পারে না। আর এই সৌন্দর্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলো কেল্লাটি সেই প্রাচীন আমলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি প্রবেশদ্বার এবং চারটি টাওয়ার রয়েছে এই দুর্গে।

যাবোল শহরের বেশ কয়েকটি দর্শনীয় নিদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হলাম আমরা। এবার একটু প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে কেমন হয়। এখানে কিন্তু অসম্ভব উপভোগ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে দেখার মতো। "শিলা জঙ্গল" তেমনই একটি প্রাকৃতিক এলাকা।

সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি সংরক্ষিত এলাকা এই শিলা বনাঞ্চল। আরেকটি সংরক্ষিত এলাকা হামুনের দক্ষিণে এই বনাঞ্চলটি অবস্থিত। যাবোল শহর থেকে আশি কিলোমিটার দূরে পড়েছে বনটি। বনের আয়তন ছয় হাজার পাঁচ শ পঁচিশ হেক্টর। এই বনাঞ্চলের আবহাওয়া গরম এবং মরুময় শুষ্ক। ফলে গাছপালাগুলো দেখতে খুব বেশি তরতাজা মনে হয় না। বহু প্রজাতির ঘাস, উদ্ভিদ ও গাছগাছালি রয়েছে এই বনে। এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বিরল ও ওষুধি গুণাবলি সম্পন্ন কিছু ভেষজ।

বেশ কিছুদিন ধরে আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বৃহৎ প্রদেশ সিস্তান ও বেলুচিস্তানের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ