ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২ ২০:০৫ Asia/Dhaka

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যুদ্ধ চলছে। কি হবে কেউ জানে না! এদিকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেবে বৃটেনসহ ২৫ টি দেশ। উভয়পক্ষের বহু সেনা ও বেসামরিক মানুষ হতাহতের দাবি করছে তারা। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ নিয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আকমল হোসেন বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি অশনি সঙ্কেত।

তিনি বলেন, অনেকে বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে যাওয়ার আগে বিষয়টিকে নিশ্চয়ই থামানোর চেষ্টা করা হবে। তা নাহলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, তৈরি ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আকমল হোসেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। বিশ্ব দেখছে একটি যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে  এখন পর্যন্ত উভয়পক্ষ তাদের  সেনাসহ বেসামরিক মানুষের হতাহতের দাবি জানিয়েছে। তো ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যুদ্ধ চলছে

অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এই পরিস্থিতি খুব বিপদসঙ্কুল বলে মনে করছি। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন তো স্পষ্ট-যারফলে যুদ্ধ। তবে এই দ্বন্দ্ব কিন্তু এখনই তৈরি হয় নি। ইউক্রেনের উপর পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন থাকা এবং ইউক্রেনের পাশে রাশিয়ার অবস্থান। বিষয়টিকে যদি এভাবে দেখি স্নায়ু যুদ্ধ পরবর্তীকালে আঞ্চলিক শান্তিতো বটেই একটু প্রসারিত দৃষ্টিতে দেখলে বিশ্ব শান্তির জন্য আজকের ইউক্রেন যুদ্ধ একটি অশনি সঙ্কেত বলে আমি মনে করি। কেননা স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীতে দুটো পরাশক্তি এরকম মোকাবেলা আগে করেনি। যদিও আজকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই কিন্তু শক্তির বিচারে রাশিয়াকে আমরা পরাশক্তি হিসেবে দেখব।  যদিও যুদ্ধের এ পর্যায়ে ইউক্রেনের সেনারা রাশিয়ার মোকাবেল করছে। তবে তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো রয়েছে। ফলে এই ইস্যুতে বিশ্বের দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকছে।

রেডিও তেহরান: আপনি এই যুদ্ধকে অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছেন। তো  যে বিষয়টি নিয়ে  রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের এই যুদ্ধ শুরু হলো।  ন্যাটো নিয়েই মূলত আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে ন্যাটোর সম্পৃক্ততা, ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হতে যাওয়া এবং সেখানে ন্যাটো সেনার আসার যে কথা; রাশিয়া সেটা কিভাবে দেখছে একইসাথে আমেরিকা কিন্তু এ বিষয়ে হুশিঁয়ারি দিয়েছে। তো এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হতে পারে?

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন

অধ্যাপক আকমল হোসেন:  দেখুন, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকেই আসছে। এখন আমেরিকার উদ্দেশ্যটা আসলে কি? দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ন্যাটোর যখন জন্ম হলো সেটি একটি সামরিক জোট। এই জোট গঠিত হলো সোভিয়েত ইউনিয়েনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। তখন বলা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ্রাসী হলে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো একত্রিত মোকাবেলা করবে। ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ৩০ এ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে কিংবা ভাবা হচ্ছে সেটা রাশিয়ার পক্ষে সহ্য করাটা সম্ভব না। কেননা ইউক্রেন রাশিয়ার একদম নিকটবর্তী ভূখণ্ড। ফলে পুতিনের বক্তব্য তারা ন্যাটো সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি মেনে নেবে না। ফলে রাশিয়ার দিক থেকে যুক্তি হচ্ছে তার নিরাপত্তার বিষয়। রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করতে চায় তারা। একইভাবে আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের কাছাকাছি কিংবা তাদের ব্যবস্থার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী কোনো কিছুকে তারা মেনে নেয় নি এবং হতে দেয়নি। ফলে আমেরিকানরাও তাদের অঞ্চলে অপর কোনো রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি কিংবা সামরিক শক্তির উপস্থিতি যেটা তাদের ভাষায় তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। একই চিত্র আমরা দেখছি। তারাও ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটের মধ্যে শামিল করাটাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এটাই তো মূল বিষয়। এরসাথে আমি আরও একটু যাব। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। রুশ এবং ইউক্রেনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটা আস্তে আস্তে আজকের যুদ্ধে রুপ নিয়েছে। রাশিয়া এখন ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সেটাকে বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আকমল হোসেন,  আপনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বললেন অবশ্য তার আগে একটি কথা বলেছেন-আমেরিকা তাদের কাছাকাছি অন্য কোনো শক্তির উপস্থিতি মেনে নেয়নি; তারা বাধা দিয়েছে। রাশিয়াও ঠিক তেমনি তাদের প্রতিবেশী দেশে ন্যাটোর উপস্থিতির সম্ভবানার বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না। তো এই যুদ্ধের ফলে যে বিষয়টি সামনে আসছে সেটি হচ্ছে এটি কি তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে যেতে পারে? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হিসেবে আপনার বিশ্লেষণ কি?

অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কথা বলতে পারি। অনেকে বলেও থাকেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর যখন পৃথিবীতে বিভক্তি এসে গেল, মতাদর্শের ভিন্নতা এসে গেল এবং বিভিন্ন রকম সামরিক জোট তৈরি হলো। একদিকে পুঁজিবাদী বিশ্ব অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তখনও এরকম অনেক ধরনের আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হতো। তখনও তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কথা বলা হতো। কিন্তু বস্তুত বিশ্ব যুদ্ধ তো একটা অনেক বড় ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বহু দেশ জড়িয়ে পড়েছিল। বহু সম্পদ ধ্বংস হয়েছিল বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে আজকের যে যুদ্ধ এ যুদ্ধ প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তার একটি পর্যায় আছে। আমি বলতে চাইছি যদি বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয় এবং যদি প্রচলিত অস্ত্রের বাইরে চলে যায় অর্থাৎ মারণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত অস্ত্রের বাইরে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সেটা পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ হবে। আমরা জানি যে জাপানই একমাত্র পরমাণু অস্ত্রের হামলার শিকার হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে আগে। এর ভয়াভয়তা এবং ফল আমরা জানি। এই উদাহরণ যখন পৃথিবীর মানুষের সামনে আছে সেহেতু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাওয়ার মতো ঐ পরিস্থিতিতে যাওয়ার আগে বিষয়টিকে নিশ্চয়ই থামানোর চেষ্টা করা হবে। তা নাহলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার মনে হয় এ বিষয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হবে। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়াও এশিয়ার যেসব দেশ  এখন শক্তিমত্তা এবং প্রভাবের দিকে দিয়ে সামনে চলে এসেছে তারা যুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নেবে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আকমল হোসেন, আপনি বললেন তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে যাওয়ার আগেই এ যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেবে বিশ্বের দেশগুলো। আচ্ছা চীনের ভূমিকা কি হতে পারে?

অধ্যাপক আকমল হোসেন: চীন দুই পক্ষকে সংযত হতে বলেছে। উভয়পক্ষকে কথাবার্তায় এবং আচরণে সংযত হওয়ার আহবান জানিয়েছে। এই ধরনের সম্ভাবনা আছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা অন্তত আমি দেখছি না।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা এ যুদ্ধ কি দীর্ঘ হতে পারে?

অধ্যাপক আকমল হোসেন: জ্বি, বড়জোর যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হতে পারে। মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে এমন কথা বলা সম্ভব না।

তো জনাব, অধ্যাপক আকমল হোসেন ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ