মার্চ ০৩, ২০২২ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ক্বাফ'এর সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরার মূল বিষয়বস্তু পরকাল সংঘটনের প্রমাণসমূহ, ভালো ও মন্দ মানুষের পরিণাম এবং অতীত জাতিগুলোর কাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। এই সূরার ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ وَنَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِهِۦ نَفۡسُهُۥۖ وَنَحۡنُ أَقۡرَبُ إِلَيۡهِ مِنۡ حَبۡلِ ٱلۡوَرِيدِ (16)

“আর আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি, আর তার প্রবৃত্তি তাকে [নিত্য নতুন] কী কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আমি তার ঘাড়ের শিরা থেকেও নিকটবর্তী।” (৫০:১৬)

গত আসরে আমরা বলেছি যে, সূরা ক্বাফের মূল বিষয়বস্তু পরকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। এই আয়াতে মানুষের নিত্যকার কাজকর্মের ওপর আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন এবং তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অবস্থা আল্লাহর নখদর্পণে রয়েছে। মানুষ যেসব কাজ প্রকাশ্যে ও গোপনে করে আল্লাহ তার সবকিছু জানেন। সেইসঙ্গে মানুষ কি চিন্তাভাবনা করে সে সম্পর্কেও তিনি সম্যক অবহিত। মহান আল্লাহ তার অসীম দয়ার কারণে মানুষের অন্তরের খারাপ চিন্তাগুলোকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

তবে সেই কুচিন্তাগুলো বাস্তব কাজে পরিণত হয়ে গেলে সেজন্য বান্দাকে জবাবদিহী করতে হবে।  আরবি ‘ওয়ারিদ’ শব্দকে ফার্সি ভাষায় শাহরগ বলা হয়। এটি হচ্ছে প্রধান অথবা এমন প্রাণধারক ধমনী যা কেটে গেলে মানুষের মৃত্যু হয়ে যায়। কণ্ঠনালীর দুই পাশে অবস্থিত এই ধমনী মানুষের কাঁধ পর্যন্ত থাকে। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বলছেন, তিনি এই শাহরগ অপেক্ষা মানুষের নিকটবর্তী।  মানুষের জীবন্মৃত্যু যে আল্লাহর হাতে রয়েছে এই আয়াতে তা বোঝানো হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মহান আল্লাহর জ্ঞান ও শক্তির কোনো সীমা নেই এবং মানুষ সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। মানুষের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞান ব্যাপক বিস্তৃত ও নিখুঁত। কাজেই আমরা যদি মনে করি আল্লাহ আমাদের অন্তরের খবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন তাহলে আমরা ভুলের মধ্যে রয়েছি।

২- আমরা যদি আমাদের অন্তরের কুমন্ত্রণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে এটি আমাদেরকে নানাভাবে খারাপ ও অশ্লীল কাজের দিকে ধাবিত করবে। কুচিন্তা পরিহার না করলে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

সূরা ক্বাফ 'এর  ১৭ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِذۡ يَتَلَقَّى ٱلۡمُتَلَقِّيَانِ عَنِ ٱلۡيَمِينِ وَعَنِ ٱلشِّمَالِ قَعِيدٞ (17) مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ (18)

“যখন তার ডানে ও বামে [ওৎ পেতে] বসা দু’জন ফেরেশতা পরস্পর [ভালো ও মন্দ কাজগুলো] গ্রহণ করে।”(৫০:১৭)

“মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে [তা লিপিবদ্ধ করার জন্য] তৎপর প্রহরী [অর্থাৎ ফেরেশতা] তার নিকটেই রয়েছে।” (৫০:১৮)

আগের আয়াতে মানুষের চিন্তাশক্তির ওপর আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান নিয়ে আলোচনার পর এই আয়াতে মানুষের সকল কর্ম লিপিবদ্ধ করে রাখার কথা বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের জন্য দু’জন করে ফেরেশতা নিয়োগ দিয়েছেন যারা প্রতি মুহূর্তে তার কাজকর্মের হিসাব রাখছে। তারা মানুষের ভালো ও মন্দ সব কর্ম লিখে রাখছে এবং তাদের দৃষ্টিতে মানুষের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।

বহু মানুষ তাদের মুখনিসৃত কথাগুলোকে তাদের দৈনন্দিন কর্ম হিসেবে গণ্য করে না এবং গুরুত্ব দেয় না। অথচ পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কথা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে পবিত্র কুরআনে হিসাব নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের বলা কথাগুলোকে আলাদাভাবে স্বরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে: মুখ থেকে যে কথাই নিঃসৃত হোক না কেন ওই দুই ফেরেশতা তা লিখে রাখেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব খবর জানেন। তারপরও তিনি যেকোনো কাজের জন্য মাধ্যম নিযুক্ত করেছেন। তিনি মানুষের ভালো ও মন্দ কর্মগুলোর রেকর্ড রাখার জন্য দু’জন ফেরেশতা নিয়োগ দিয়েছেন।

২- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পর আরো সেযব অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে সেগুলোর মধ্যে ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস অন্যতম।

৩- মানুষকে শুধু তার কাজকর্মের জন্য নয় বরং তার বক্তব্যের জন্যও হিসাব দিতে হবে। মানুষের এমন কোনো কর্ম নেই যা সে করে কিন্তু লিপিবদ্ধ হয় না।

সূরা ক্বাফ 'এর  ১৯ থেকে ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَجَآءَتۡ سَكۡرَةُ ٱلۡمَوۡتِ بِٱلۡحَقِّۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنۡهُ تَحِيدُ (19) وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِۚ ذَٰلِكَ يَوۡمُ ٱلۡوَعِيدِ (20) وَجَآءَتۡ كُلُّ نَفۡسٖ مَّعَهَا سَآئِقٞ وَشَهِيدٞ (21) لَّقَدۡ كُنتَ فِي غَفۡلَةٖ مِّنۡ هَٰذَا فَكَشَفۡنَا عَنكَ غِطَآءَكَ فَبَصَرُكَ ٱلۡيَوۡمَ حَدِيدٞ (22)

 “মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই আসবে [এবং মানুষকে বলবে যে,] এটা হচ্ছে সেটা যা থেকে তুমি সর্বদা পালিয়ে বাঁচতে চাইতে।” (৫০:১৯)

“অতঃপর [কিয়ামতের দিনের] সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। এটাই হল প্রতিশ্রুত শাস্তি [বাস্তবায়নের] দিন। ”  (৫০:২০)

“প্রত্যেক ব্যক্তি [কিয়ামতের ময়দানে] এমন অবস্থায় আসবে যে একজন [ফেরেশতা] তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসবে আর একজন [ফেরেশতা] থাকবে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে।”  (৫০:২১)

“[তাকে বলা হবে] অবশ্যই তুমি এ [দিন] সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, অতঃপর আমি তোমার সামনে থেকে [উদাসীনতার] পর্দা উন্মোচন করেছি। সুতরাং আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর হয়েছে।”  (৫০:২২)

মৃত্যুর সময় মানুষকে ভয়ঙ্কর ভয় ও আতঙ্কে পেয়ে বসে। বেশিরভাগ মানুষ মুত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়, এমনকি মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করতেও সে আগ্রহী নয়। যদি মৃত্যু নিয়ে তাকে চিন্তা করতেই হয় তবে সে অপরের মৃত্যু নিয়ে ভাবে। কিন্তু কুরআনের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: মৃত্যু হচ্ছে এক কঠিন সত্য এবং তোমরা তার জন্য প্রস্তুত থাকো বা না থাকো সবাইকে এর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

তবে মৃত্যু মানে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয় বরং এক জগত থেকে আরেক জগতে স্থানান্তর মাত্র। মৃত্যুর মাধ্যমে ঘনিষ্ঠজন থেকে মানুষকে বিদায় নিতে হয় যা ভয়ঙ্কর কষ্টের একটি মুহূর্ত। মানুষের জন্মের দৃশ্যও এমনই হয়। যখন মানুষ ভ্রুণের জীবন থেকে পৃথিবীর জীবনে পদার্পণ করে তখন তার নাভি কেটে তাকে মায়ের পেট থেকে ছিন্ন করা হয় এবং সে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে।

জন্মের সময় আমরা মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে পা রেখেছি। মৃত্যুর পরে আমাদেরকে এই পৃথিবীর পেটে ঢুকে যেতে হবে এবং যেদিন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন সেদিন এই পেট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এই পৃথিবীতেই পা রাখতে হবে। কিন্তু এবার পা রাখতে হবে আগেরবারের কৃতকর্মের হিসাব দিতে। পার্থিব জীবনের মতো কিয়ামতের দিনও আমাদের সঙ্গে থাকবে দু’জন ফেরেশতা। তারা দুনিয়ার জীবনে আমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। সেদিন মানুষ উপলব্ধি করবে যে, এই চরম সত্য সম্পর্কে তারা কতখানি উদাসীন ছিল এবং এই দিনের জবাবদিহীতার জন্য নিজেকে মোটেও প্রস্তুত করেনি।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।

২- প্রতিটি মানুষকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ওই মুহূর্তে সে এতটা আতঙ্কে থাকে যে, তার পক্ষে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হয় না বরং সে অস্থির হয়ে যায়।

৩- পরকাল সম্পর্কে উদাসীনতা মানুষের জন্য মস্তবড় হুমকি। এই উদাসীনতার কারণে মানুষ পার্থিব জীবনের প্রতি অতিরিক্ত মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যা তার জন্য বিপদের কারণ হয়।

৪- পার্থিব জীবনের চাকচিক্য মহাসত্য ও মানুষের মাঝখানে বিভেদের পর্দা হিসেবে কাজ করে। এ কারণে উদাসীন মানুষ সূক্ষ্মদর্শী হয় না। কিন্তু কিয়ামতের দিন এই বিভেদের পর্দা সরে গেলে মানুষের দৃষ্টি প্রখর হয়ে পড়ে এবং সে মহাসত্য উপলব্ধি করে। কিন্তু পার্থিব জীবনে উদাসীন থাকলে কিয়ামতের দিনের উপলব্ধি কোনো কাজে আসে না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ