মার্চ ০৫, ২০২২ ১৯:৪৫ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই হিজরী সপ্তম শতাব্দীর বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর নাম শুনেছো। তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে মসনবী। তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে মসনবী রচনা করেন।

মাওলানা রুমীর মসনবীতে পবিত্র কুরআনের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। কুরআনে যেমন প্রসঙ্গক্রমে বিভিন্ন গল্প-কাহিনীর উল্লেখ করা হয়েছে, মসনবীতেও তেমনি মাওলানা রুমী তাঁর চিন্তাদর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে গল্প-কথার আশ্রয় নিয়েছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে- মাওলানা রুমী তাঁর মসনবী গ্রন্থে পবিত্র কুরআনের অন্তত দুই হাজার ২০০টি আয়াতের প্রতি সরাসরি ইঙ্গিত করেছেন কিংবা কবিতার আঙ্গিকে তিনি আসলে কুরআনের আয়াতেরই ব্যাখ্যা করেছেন। এ কারণেই হিজরী ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত মরমী কবি মরহুম হাজ্জ্ব মোল্লা হাদী সাবজেভরি মসনবীকে কুরআনের তাফসীর এবং মাওলানা রুমীকে কুরআনের একজন মুফাসসির বলে উল্লেখ করেছিলেন।

মসনবী এমন এক অনন্য সাধারণ গ্রন্থ যা আজও তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এবং আধুনিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আটশ' বছর আগের এই গ্রন্থে কল্পনাভিত্তিক গল্প, রূপকধর্মী গল্প, রহস্যময় গল্প, আধ্যাত্মিক গল্প, শিক্ষণীয় গল্প, নৈতিক বা চারিত্রিক গল্প রয়েছে। আজকের আসরে মাওলানা রুমীর লেখা মসনবী শরীফের দ্বিতীয় খণ্ড একটি গল্প শোনাব। আর গল্প শেষে থাকবে একটি গান। আর সবশেষে থাকবে বাংলাদেশের এক ছোট্ট বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

একদা এক ব্যক্তি কোনো জ্ঞানী লোকের সন্ধান করছিল। জীবনের বড় একটি সমস্যায় জ্ঞানী লোকের পরামর্শের প্রয়োজন ছিল তার। লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করছিল, এমন লোকের সন্ধান কীভাবে পাওয়া যায়?

এক লোক বলল; এই শহরে মাত্র একজন জ্ঞানী লোক আছেন। কিন্তু থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তিনি পাগলের ছদ্মবেশ ধরে ঘুরেন। হাতে তার বাঁশের একটি কঞ্চি। সেটিকে ঘোড়া বানিয়ে তার ওপর চড়ে দৌড়ান। পোলাপানের মাঝে গিয়ে বলেন, এটি আমার ঘোড়া। ওই দেখুন, দুই পায়ের মাঝখানে কঞ্চি চেপে দৌড় দিচ্ছেন : ‘হুররা। এই আমার ঘোড়া।’ আসলে লোকটি জ্ঞানী। পাগলের বেশ ধরে আত্মগোপন করে আছেন।

সন্ধানী লোকটি কঞ্চি আরোহী পাগলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাক দিয়ে বললেন, 'হে অশ্বারোহী! আপনার ঘোড়াটা একটু আমার দিকে ঘুরান দেখি।' তৎক্ষণাৎ কঞ্চির ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে পাগল হাজির। বলল, 'জলদি বলো, কী চাই তোমার। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না। আমার ঘোড়ার পাগলামি আছে। সে কিন্তু অবাধ্য। পায়ের আঘাতে তোমাকে ফেলে দেবে।'

লোকটি বলল, 'আমার জানার বিষয়টি হলো এই মহল্লায় আমি বিয়ে করতে চাই। আপনার মতে, কোন্‌ ধরনের পাত্রী আমার জন্য ভালো হবে?'

ছদ্মবেশী পাগল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল: 'সমাজে তিন ধরনের মেয়ে আছে। এর দুই ধরন নিয়ে শান্তি নেই, কপালে দুঃখ লেখা। তৃতীয় ধরনের মেয়ে তোমার জন্য সম্পদের খনি, সৌভাগ্যের ধন। এই তিন কিসিমের মহিলার মধ্যে যে প্রথম ধরনকে বিয়ে করবে, সে স্ত্রী হবে সম্পূর্ণ তোমার। তার রূপগুণ একা তুমি ভোগ করবে। দ্বিতীয় ধরনের স্ত্রীর অর্ধেক তোমার আর অর্ধেক অন্যের। তৃতীয় ধরনের স্ত্রীর কথা বলি- তোমার আর তার মধ্যে এতই দূরত্ব হবে, যেন তোমার সঙ্গে তার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। জবাব শুনলে তো। এবার জলদি চলে যাও। নতুবা আমার ঘোড়া পদাঘাত করবে তোমাকে।'

এ কথা বলেই পাগল ছুটল তার কঞ্চির ঘোড়া নিয়ে। ছেলেপেলের দলে গিয়ে খেলায় সে আবার মশগুল হলো।

আর এদিকে প্রশ্নকারী একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলেন না এই জবারের গূঢ় রহস্য। তাই তিনি দৌড় দিলেন পাগলের পেছনে। কাছে গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জনাব, আরেকটু আসুন। আপনি যে কথাগুলো বললেন, আমার তো বুঝে এলো না। দয়া করে একটু ব্যাখ্যা করুন।

পাগল আবার ছুটে এলো তার কাছে। বলল, প্রথম যে স্ত্রীর কথা বলেছি, যে পুরোপুরি তোমার হয়ে যাবে, সে হলো অবিবাহিতা কুমারি মেয়ে। রূপগুণে ব্যবহারে সে তোমাকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখবে। দ্বিতীয় ধরনের যে স্ত্রীর কথা বলেছি, সে হলো কোনো বিধবা নারী। যদি কোনো বিধবাকে তুমি বিয়ে কর, তাহলে তার অর্ধেকটা তুমি পাবে, বাকি অর্ধেক থাকবে অন্যের। তার মনের অর্ধেকটা থাকবে আগের স্বামীর কাছে। আর তৃতীয় যে মহিলার কথা বলেছি, সে হলো এমন মহিলা, যার আগের স্বামীর ঘরের শিশুসন্তান কোলে আছে। কোলের শিশুর কারণে মহিলার মন বারে বারে সন্তানের বাবা, আগের স্বামীর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে। পাগল বলল, ব্যাখ্যা শুনলে তো, সরে যাও। আমার ঘোড়ার পথ ছেড়ে দাও। তোমার গায়ে যেন লাথি না মারে। একথা বলে চলে গেল ছেলেদের দলে।

ছদ্মবেশী পাগলের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তায় লোকটি হতবাক। তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। এতবড় জ্ঞানী লোক কেন এভাবে পাগলের বেশে ছেলেপেলের দলে মিশে আছে, জানতে হবে। তাই তিনি এগিয়ে গেলেন পাগলের দিকে। ডাক দিলেন, হে ঘোড়-সওয়ার বন্ধু! আরেকটি প্রশ্ন আছে। জবাব দিন। তারপর চলে যাব।

পাগল বলল: জলদি বল। আমার সময় নেই।

লোকটি বললেন: আচ্ছা আপনার যে এত জ্ঞানবুদ্ধি প্রজ্ঞা, তাপরও এসব ছেলেমি পাগলামি করেন কেন? এর পেছনে কারণ কী?

পাগল জবাবে সেসময়কার শাসকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল: এই অসভ্যটা চাচ্ছে যে, আমাকে শহরের কাজী পদে নিয়োগ দেবে। তখন বিচারকের এজলাসে বসে তার মর্জি মতো আমাকে ফয়সালা দিতে হবে। বহু চেষ্টা করেছি, যাতে এ দায়িত্ব এড়ানো যায়। কিন্তু সে নাছোড়বন্দা। আমাকে রেহাই দেবে না। কাজেই উপায়ান্তর না দেখে এ পথ বেছে নিয়েছি। পাগলের বেশ ধারণ করেছি, যাতে এই জালিম শাসকের অধীনে জজের পদ গ্রহণ করতে না হয়।

পাগলবেশি জ্ঞানী লোকটি আরও বলল: এসব জালিম গোমরাহরা আমাকে ডাকছে তাদের জুলুম-অত্যাচারে সাহায্য করার জন্য, যদি তার মোকাবিলায় নিজে পাগলের বেশ ধারণ না করি, তাহলে আমিই হব আসল পাগল। শুধু আমি নই, যে কেউ এসব জালিম জল্লাদদের দেখে নিজের জ্ঞানের হেফাজতের জন্য পাগলের বেশ ধারণ করে না, আসলে সে পাগল এবং চরম মূর্খ। কারণ, আসল জ্ঞান সেটি, যা হাকিকতের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে। হাকিকত মানে পরম সত্য, তাৎপর্য ও সারসত্তা। যে জ্ঞান পেশাগত অর্থ উপার্জনের জন্য, তা জৈবিক চাহিদা পূরণের হাতিয়ার ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমার জ্ঞান প্রথম ধরনের, যা হাকিকতের সঙ্গে মিশ্রিত। সেটিই সৌভাগ্যের পরশমণি। আমার এ জ্ঞান দ্বিতীয় ধরনের নয়। সেটি অর্থ উপার্জনের পণ্য। আমার এই অমূল্য জ্ঞান আমি আল্লাহর পরম সৌন্দর্যের সঙ্গেই বিনিময় করি। হালাল উপার্জনেই ব্যয় হয় আমার দক্ষতা, পাণ্ডিত্য। শয়তানের সহযোগী হয়ে আমার জ্ঞান হারাম উপার্জনের পথে যায় না।

একটু দম নিয়ে পাগল লোকটি আবার বলল: আমার জ্ঞানের উপমা রত্নের খনি আর আমি বিরানভূমি। পতিত বিরান ভূমিতেই লুকিয়ে থাকে অনন্ত রত্নখনি। আমি যদি পাগল বেশ ধারণ না করি, যদি ভেতরের রত্নখনি প্রকাশ করে দিই, তাহলে পাগল সাব্যস্ত হব। পাগল ছাড়া কেউ নিজের গুপ্তধন অন্যের কাছে খুলে দেয় না। আমার জ্ঞান অমূল্য রতন। আজেবাজে জিনিস খরিদ করার জন্য ওই অমূল্য রত্ন ব্যয় করব না। এই অমূল্য রত্ন দিয়ে খরিদ করব, পরম আরাধ্যের প্রেম ও সন্তুষ্টি। আমার চলায় বলায় সাধনায় আল্লাহকে রাজি করার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছু থাকবে না। কারণ, আমার ক্রেতা স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই আমাকে নিয়ে যাবেন ওপরের দিকে- জান্নাত কাননের পানে। সুরা তওবায় সে কথাই বলেছেন। আল্লাহ মোমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন চিরসুখের জান্নাতের বিনিময়ে।

বন্ধুরা, এ গল্পের শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে- জ্ঞানকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য রাসুলেপাকের দেখানো পথে, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিয়োজিত করতে হবে; দুনিয়ার কাদামাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার জন্য নয়। তবে আল্লাহর একান্ত দয়ার হাতছানি ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর দরবারে মওলানা রুমির আকুতি:

 ‘বাঁচাও, বাঁচাও, রেহাই দাও নিজ হাত হতে আমাকে,

পর্দা সরাও, লজ্জা দিও না আমার সম্ভ্রমের পর্দা ছিঁড়ে।’

অর্থাৎ- আমার হাত ধর, বাঁচাও, উদ্ধার কর। আমার হাত থেকে আমাকে খরিদ করে নাও। আমাকে আমার ওপর ছেড়ে দিও না। নফসে আম্মারার কবল থেকে, বস্তুগত অস্তিত্বের জিঞ্জির থেকে আমাকে মুক্তি দাও। তোমার আমার মাঝখানের পর্দাখানি সরিয়ে দাও। আমি তোমার কাছে আসতে চাই। তোমার সান্নিধ্য চাই। আমার মান সম্ভ্রমের পর্দা ছিন্ন করো না। লজ্জিত করো না। আমার জারিজুরি যেন ফাঁস হয়ে না যায় সমাজে, মানুষের কাছে।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, বড় হতে হলে জ্ঞান চর্চা করতে হয়। আর জ্ঞানী হতে হলে করতে হয় অনেক বেশি পড়াশোনা। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে এ সম্পর্কেই রয়েছে একটি গান। গানটির গীতিকার গোলাম মোহাম্মদ, সুরকার গোলাম মাওলা আর গেয়েছে বাংলাদেশের সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদের শিশুশিল্পী হিশাম, স্বাধীন, ইমন, তাহিয়া, জান্নাত ও জাইমা। 

পড়াশোনার গুরুত্ব সম্পর্কে একঝাঁক ছোট্টবন্ধুর কণ্ঠে গানটি শুনলে। আশা করি ভালো লেগেছে। বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এক ছোট্টবন্ধুর সাক্ষাৎকার।

তো রংধনু আসরে অংশ নেওয়ার জন্য মাহজাবিন, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে বিদায় নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ