মার্চ ০৯, ২০২২ ২০:৪৪ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সেমনান প্রদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত একটি শহরে গিয়েছিলাম। শহরটির নাম হলো দমগন। দমগনের ঐতিহাসিকতা এবং এই শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা আমরা কিছুটা বলার চেষ্টা করেছি। পরিসমাপ্তি টেনেছিলাম হেসর টিলার প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা বলে।

মাটির হৃদয় থেকে মানব বসতির বিচিত্র প্রমাণ ও নিদর্শন এখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। যে সময়ের কথা বলছি তখনকার দিনের স্থাপত্য ছিল ছোটো ছোটো কক্ষ বিশিষ্ট ঘর। সিঁড়ির মাধ্যমে এক কক্ষের সঙ্গে অপর কক্ষের সংযোগ রক্ষার ব্যবস্থা ছিল। একেবারেই সাদামাটা জীবন যাপন করতো তখনকার দিনের মানুষেরা।

হেসর টিলার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক যোগানের তিনটি মূল উৎস ছিল। এক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ। দুই, পশুপাখি পালন করা এবং তিন, কৃষিকাজ করা। এ এলাকায় খোদাই করা শত শত মুদ্রা পাওয়া গেছে। এগুলো প্রমাণ করছে সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসী কিংবা ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জনগণের সাথে হেসর টিলায় বসবাসকারীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এই সময় নীলা পাথরের মতো মূল্যবান পাথর আফগানিস্তানের বাদাখশান এবং জালালাবাদ থেকে আসতো আর মূল্যবান ফিরোজা পাথর দমগন থেকে উত্তোলন করা হতো এবং সেগুলো রপ্তানী করা হতো। সিলভার ধাতুও দমগন থেকে সে সময় রপ্তানি করা হতো বলে বিভিন্ন উপাদান থেকে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি থেকে জানা যায় এ এলাকার জনগণ বিত্ত-বৈভব, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও বিকাশের দিক থেকে ব্যাপক উন্নত হবার কারণে শত্রুদের হামলার শিকার হয়েছে বারবার। মঙ্গল টিলা নামের টিলাগুলো দমগনশহরের দক্ষিণে অবস্থিত। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের নভোচারীরা এই এলাকাকে মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে ব্যাপক মিল আছে বলে অভিমত দিয়েছে। নি:সন্দেহে সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন স্তরগুলো থেকে শুরু করে হেসর টিলাগুলোর অভিনতুন স্তরগুলোর মধ্যেও ইরানের কয়েক শতাব্দীর স্থাপত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মানবজীবনাচারগুলো নিহিত রয়েছে। ভবিষ্যতে এখানকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি যে আরও বেশি সমৃদ্ধ ও আলোকিত হবে নি:সন্দেহে। সাধারণত কোনো ভ্রমণকারী এই দমগনে বেড়াতে গেলে অবশ্যই এখানকার ঐতিহাসিক 'তরিখনে মসজিদ' পরিদর্শন না করে পারেন না। এই মসজিদ ইসলামি যুগের প্রাচীন ও অনন্য সাধারণ একটি স্থাপত্য যার খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। সাসানি শাসনামলের স্থাপত্যশৈলির আদলে নির্মিাণ করা হয়েছে মসজিদটি।

হিজরি তৃতীয় এবং চতুর্থ শতকে ভূমিকম্পের ফলে মসজিদ স্থাপনার কিছুটা ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। তরিখনে মসজিদ আল্লাহর ঘরের নামে নামকরণ করা হয়েছে। যদিও এই মসজিদের আরও একটি নামও রয়েছে। সেটি হলো চেহেল সুতুন মসজিদ। মসজিদে কিছু চারুলিপির কারুকাজ রয়েছে। এইসব লিপিতে মসজিদের নির্মাণকালেরও উল্লেখ রয়েছে। নির্মাণের প্রামাণ্য তারিখ উল্লেখ থাকলেও মসজিদের স্থাপত্য শৈলি বিচার করে ধারণা করা যায় যে এটি ইসলামি যুগের প্রাথমিক দিককার স্থাপনা।

তরিখনে মসজিদের স্থাপত্যশৈলি ও প্রামাণ্য তারিখ নিয়ে। ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই মসজিদটির বিশেষত্ব সাসানি যুগের স্থাপত্য নিদর্শনের দিক থেকেও বিবেচ্য। পুরোপুরিই বিদেশি উপাদান উপকরণ ছাড়া একান্তই ইসলামি বৈশিষ্ট্যের আলোকে ডিজাইন করা হয়েছে তরিখনে মসজিদের। মসজিদের দেয়াল এবং তাকগুলো ইট এবং রোদে পোড়া ইটের সংমিশ্রণে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ স্থাপনার উল্লেখযোগ্য সুন্দর দিকটি হলো খুবই সাধারণ উপাদান উপকরণের ব্যবহার। মজার ব্যাপার এই সাধারণ উপাদানগুলো আজও দেখতে পাওয়া যায়।

দমগনের ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকা এখানেই শেষ নয়। দমগন জামে মসজিদও এই শহরের অপর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। মসজিদটি এখন দমগন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। এর বিভিন্ন অংশ কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু অংশ পুনরায় মেরামত করা হয়েছে। জামে মসজিদের সবচেয়ে প্রাচীন অংশটি হলো ঝুলবারান্দা এবং শাবেস্তান। মসজিদের মিনারটিও দেখার মতো। টাইলসের কারুকাজে সমৃদ্ধ মিনার দূর থেকেও ঝকমকে মনে হয়। মিনারটি হিজরি পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বিখ্যাত ভুবন পর্যটক মোকাদ্দাসি তার ভ্রমণ কাহিনীতে এই জামে মসজিদ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনিও এই মসজিদ স্থাপনাটিকে হিজরি পঞ্চম শতকের শেস দিককার বলে মত দিয়েছেন। মসজিদের মিনারটির উচ্চতা বত্রিশ মিটার। কুফি অক্ষরে দুটি ক্যালিগ্রাফি এই মিনারের গায়ে সুসজ্জিত রয়েছে। এই কারুকাজটি করা হয়েছে ইটের সাহায্যে।

দমগন জামে মসজিদ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। মসজিদের পাশেই ইমামযাদা জাফর (আ) এর মাজার। এই মাজার কমপ্লেক্সে আরও কয়েকটি কবর রয়েছে। কবরগুলো ইমামযাদা মুহাম্মাদ (আ) এবং  শাহরুখের। আরও রয়েছে 'চেহেল দোখতারন' মানে চল্লিশ বোন স্থাপনা। সালজুকি শাসনামলের স্থাপনা এই কমপ্লেক্স ইরানের ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত হয়েছে। ইমামযাদা জাফর এবং চেহেল দোখতারন কবর স্থাপনার দেয়ালে দুটি ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। কুফি অক্ষরে লেখা ওই ক্যালিগ্রাফিগুলো কবর স্থাপনাকে আলাদা সৌন্দর্যে ভূষিত করেছে। দমগনের ঐতিহাসিক এই নিদর্শন পরিদর্শন শেষে কিংবা বলা যেতে পারে পুরো দমগন শহর সফর করার পর সকল পর্যটকের মনেই এখানকার স্মৃতি জ্বলজ্বলে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। আপনারাও যদি বেড়াতে যান তার ব্যতিক্রম হবে না।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ