সুখের নীড়- পর্ব ৬
আমাদের আজকের আলোচনা শুরু করছি মহানবীর এক হাদিস শুনিয়ে। তিনি বলেছেন: আল্লাহর কাছে কোনো ঘর সেই ঘরের চেয়ে প্রিয় নয় যা বিয়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়।
-আমরা কেউ কেউ অন্যদের জীবনের বাহ্যিক দিকের সঙ্গে নিজেদের জীবনের তুলনা করি। অন্যদের জীবনের বাহ্যিক চাকচিক্য ও সমৃদ্ধি যেন আমাদের অন্ধ করে না দেয় এবং এসব নিয়ে আমরা যেন জীবন-সঙ্গীকে বিচার না করি। আমাদের উচিত জীবন-সঙ্গীকে সম্মান করা, তাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা ও তাকে ভালোবাসা। বিয়ের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা এমন এক রোগ যা পুরুষের দৃঢ়তা ও আত্ম-বিশ্বাসকে নষ্ট করে এবং বিনষ্ট করে স্ত্রীর অনুরাগ বা স্নেহ-প্রবণতা। তাই স্বামী যদি স্ত্রীকে অন্যান্য নারীর সঙ্গে তুলনা করে তাহলে তার স্নেহ-প্রবণতা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। অন্যদিকে স্ত্রীও যদি স্বামীকে অন্যান্য পুরুষের সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করে তাহলে ওই স্বামীর দৃঢ়তা ও আত্ম-বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে যাবে।
আমাদের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখুন আঙ্গুলের মধ্যে যে রেখাগুলোর ছাপ বা বাঁক রয়েছে তা অন্য কারো আঙ্গুলের রেখাগুলোর মত নয়। এই ভিন্নতা যদি আমরা মেনে নিতে পারি তাহলে কেন স্ত্রী বা স্বামীকে অন্যদের সঙ্গ তুলনা করব? এ বিশ্বে সব ফুলের রং ও আকার এক ধরনের নয়। নানা ধরনের খাবারের স্বাদ ও গন্ধও এক রকম নয়। ভিন্নতা ও পার্থক্যই এই দুনিয়াকে করেছে সুদৃশ্যতর ও বেশি সুন্দর! মানুষ হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ধরনের এবং মানুষের রুচি, জীবন যাপনের পদ্ধতি, স্বভাব, অভ্যাস, বয়স ইত্যাদি অনেক দিকে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আর এ জাতীয় পার্থক্য মেনে নেয়া উচিত। আপনি যখন আপনার স্ত্রী বা স্বামীকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে যাবেন তখন আপনি এ বার্তাই দিচ্ছেন যে তার গ্রহণযোগ্যতা আপনার কাছে নেই এবং সে আপনার প্রত্যাশা পূরণ করে নাই বা আপনি তার ওপর সন্তুষ্ট নন। এ বিষয়টি পরিবারের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
ইরানসহ বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে ও বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি গভীর ভালবাসা দেখা যায়। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যেও পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগ দেখা যায় এইসব দেশে। এমন আন্তরিক ও গভীর ভালবাসা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে খুব কমই দেখা যায়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির মতে ইরানে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব আর ভালবাসা অত্যন্ত ব্যাপক।
ইরানি পরিবারগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এসব পরিবারের সদস্যরা সাধারণত ধার্মিক। নারী ও পুরুষের তথা স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা একটি ঐতিহ্যগত ও মানবীয় প্রকৃতিগত ভালবাসা।
বর্ণনায় এসেছে: মহান আল্লাহ যখন আদম-আ.কে সৃষ্টি করার পর প্রথম মানবী হিসেবে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন তখন আদম-আ. আল্লাহর কাছে কৌতূহলী হয়ে জানতে চান : কে এই ব্যক্তি যার দৃষ্টি ও নৈকট্য আমার মধ্যে অনুরাগের জন্ম দিয়েছে? আল্লাহ বললেন: সে হচ্ছে হাওয়া। তুমি কি চাও সে তোমার সঙ্গী হোক ও তোমার অনুরাগের মাধ্যম হোক এবং তোমার সঙ্গে কথা বলুক ও তোমার অনুগত হোক? আদম-আ. বললেন: জি! হে আমার প্রতিপালক, আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমার জন্য জরুরি। এরপর মহান আল্লাহ বললেন, তুমি আমার কাছে তাকে বিয়ে করার আবেদন জানাও, কারণ সে তোমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাও রাখে। এরপর হযরত আদম-আ বললেন: আমি তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পেশ করছি, কিসে আপনার সন্তুষ্টি রয়েছে? মহান আল্লাহ বললেন: আমার সন্তুষ্টি হল এটা যে তুমি তাকে আমার ধর্মের জ্ঞান শেখাবে। -এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় মানবীর প্রতি মানবের যে অনুরাগ তা জৈব-প্রবৃত্তি সৃষ্টির আগেই গড়ে উঠেছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার গঠনের মূল উদ্দেশ্য শারীরিক চাহিদা পূরণ নয় বরং নারী ও পুরুষের পারস্পরিক প্রশান্তি লাভ।
বিবি হাওয়াকে বিয়ে করার পর হযরত আদম-আ. হাওয়াকে বললেন: আমার কাছে আসো ও আমার দিকে তাকাও। উত্তরে মা হাওয়া বললেন, আপনি আমার দিকে তাকান। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ আদমকে হাওয়ার দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সেই থেকেই নারীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর রীতি চালু হয়।
বিশ্বের সব মানুষ তথা সব নর-নারী হযরত আদম ও হাওয়ার বংশধর। সৃষ্টিগত দিক থেকে নারীর ওপর পুরুষের কোনো প্রাধান্য নেই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের সপ্তম সুরা তথা সুরা আল আ'রাফ-এর ১৮৯ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে; আর তার থেকেই তৈরি করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে।
আদম ও হাওয়ার পরিবার থেকে পরবর্তীকালের মানব সমাজ ও মানব-প্রজন্মগুলো গড়ে উঠেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের সূচনা সেখান থেকেই। তাই পরিবার হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক বিষয়। মানব সমাজ গড়ে ওঠে পরিবার থেকেই। তাই নানা ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের উৎসও হল এই পরিবার।
ইরানি পরিবারগুলোতে ইরানি পরিচিতি ও মানব-পরিচিতি এ দুই-ই রক্ষার জন্য ধার্মিকতা এবং ঐতিহ্য বেশ গুরুত্ব পায়। মানুষের মানবিক পরিচিতি তার পারিবারিক পরিচিতি ও আত্মীয়তার ব্যবস্থার কাছে ঋণী। ইরানি প্রথা, নাম ও ঐতিহ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। বংশ বা গোত্র ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে পরিবার থেকেই। গোত্রীয় ব্যবস্থা বা উপজাতি প্রথা ইরানের অতীত ও বর্তমানের ওপর প্রভাব রেখেছে। আধুনিকতার ধাক্কাও ইরানে পরিবার-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং ইরানিরা এই ব্যবস্থাকে মজবুত করারও চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর এই কাজকে তারা নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন।
ক্লান্ত ও শ্রান্ত স্বামী যখন দিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরেন তখন স্ত্রীর উপস্থিতি ও ঘরোয়া পরিবেশ তাকে দেয় প্রশান্তি। স্ত্রীর অনুরাগ এ সময় স্বামীর প্রশান্তির জন্য বেশ জরুরি। একইভাবে স্ত্রীও সংসারে ও ঘরে-বাইরে নানা কাজ আর জটিল পরিস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়-স্থল ও প্রশান্তির জন্য স্বামীর সহযোগিতা আর সহমর্মিতার মুখাপেক্ষী। তাই স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের জন্য প্রশান্তির মাধ্যম। আর তা পেতে হলে তথা সংসারকে সুখের নীড় করতে হলে পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসা, ক্ষমাশীলতা, ত্যাগ ও অনুরাগ থাকা জরুরি।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।