মার্চ ১৭, ২০২২ ২১:৫৬ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরবর্তী ঘটনাবলী বর্ণনা করেছি। আজ আমরা ইরাকের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের ওপর সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর হামলা সম্পর্কে কথা বলব।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষ দিনগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ইরাক সরকারের সমর্থন নিয়ে প্রকাশ্যে ইরানের ওপর এদেশের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর হামলা। মাসুদ রাজাভির নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠীর নাম পিপলস মুজাহেদিন এবং তারা ইরাকের সমর্থন নিয়ে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ‘ফোরুগে জাভিদান’ নামের অভিযান চালায়।

এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং এই প্রতিরোধমূলক অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘মেরসাদ’। অভিযানে ইরানের বিপ্লব বিরোধী মোনাফেকিন গোষ্ঠী শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। ইরাকি সেনাবাহিনী তাদের একটি সামরিক ঘাঁটি মাসুদ রাজাভিকে ছেড়ে দেয় যাতে তার গোষ্ঠীর লোকজন নির্বিঘ্নে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিতে পারে।

মোনাফেকিন গোষ্ঠীর ইরান বিরোধী অভিযানের ব্যাপারে বাগদাদ ব্যাপকভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠে। এর আগেও একবার এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ইরানের মেহরান শহরে হামলা চালিয়েছিল।  সে সময় তারা স্লোগান দিয়েছিল- আজ মেহরান কাল তেহরান। যদিও তাদের মেহরান অভিযান সফল হয়নি বরং ইরানি যোদ্ধাদের পাল্টা হামলায় তারা পিছু হটে গিয়েছিল।

তবে যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এসে মোনাফেকিন গোষ্ঠী সর্বশক্তি নিয়ে সাদ্দাম বাহিনীর পাশে দাঁড়ায়। এই গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল এই যে, তারা ইরাকি সেনাবাহিনীর ট্যাংকে সওয়ার হয়ে ইরানি যোদ্ধাদের তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়েই কয়েকদিনের মধ্যে ইরানের রাজধানী তেহরান দখল করে ফেলবে। তাদের আরো ধারণা ছিল, ইরানি জনগণ এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তো ধরবেই না বরং তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তেহরানের ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেবে। গোষ্ঠীর নেতা মাসুদ রাজাভি তার বাহিনীকে এই আশ্বাস দিয়েছিল যে, তেহরান দখলের পর তারা আজাদি স্কয়ারে তাদের বিজয় অনুষ্ঠান পালন করবে।

রাজাভি ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করার রাতে তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে উদ্দেশ করে বলেন, “আমরা যেভাবে আমাদের কাজ ভাগ করে নিয়েছি তাতে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তেহরানে পৌঁছে যাবো। আমরা যা করতে যাচ্ছি সেটাকে যেকোনো পরাশক্তির অভিযানের সঙ্গে তুলনা করা যায় কারণ, কোনো পরাশক্তির পক্ষেই এত কম সময়ের মধ্যে একটি দেশ দখল করা সম্ভব। আর বিমান শক্তির দিক দিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। কারণ, ইরাকি বিমান বাহিনী আমাদেরকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে এবং যেসব জায়গায় প্রয়োজন সেসব জায়গায় ইরানি সেনাদের অবস্থানে বোমাবর্ষণ করবে। 

মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সেনারা এভাবে তাদের নেতার কাল্পনিক কথাবার্তায় প্রতারিত হয়ে নিজ দেশ ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তেহরানে পৌঁছে যাওয়ার আশায় তারা সীমান্তবর্তী কারান্দ ও ইসলামশাহর শহর দখল করে নেয়। ইরানের কেরমানশাহ প্রদেশে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর এই সামরিক অভিযান ইরানি কর্মকর্তাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। যদিও কোনো কোনো গোয়েন্দা সূত্র এমন হামলার আভাস দিয়েছিল কিন্তু কেউ সঠিকভাবে জানত না মোনাফেকিনরা সীমান্তের ঠিক কোন অংশ থেকে এই অভিযান শুরু করতে পারে। ওদিকে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর এই অগ্রাভিযানে ইরাকি বিমানবাহিনী সহায়তা দিতে থাকে এবং তারা এই গোষ্ঠীর অভিযানের মুখে থাকা ইরানি ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ করে। এমনকি ইরাকি বিমানবাহিনী ইরানের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে আকাশ থেকে এই মর্মে লিফলেট বিলি করে যে, এসব শহরের অধিবাসীরা যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

মোনাফেকিন গোষ্ঠীর এই হামলা প্রতিহত করতে ইরান যে অভিযান চালায় তার নাম ছিল মেরসাদ। ওই অভিযানের কমান্ডার শহীদ লে. জেনারেল সাইয়াদ সিরাজি অভিযান শুরুর রাতের অবস্থা বর্ণনা করেন এভাবে: আমি রাতের বেলায় একটি ফ্যালকন জঙ্গিবিমান নিয়ে কেরমানশাহ পৌঁছাই এবং আকাশ থেকে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করি। ইরাকি বাহিনীর লিফলেট পড়ে জনগণ ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে।  আমি কেরমানশাহ বিমানবন্দর থেকে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উড়ি আরো কাছে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯৮৮ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতে আমি আকাশে উড়ি এবং ভোর পাঁচটায় প্রদেশের তাক বাস্তান এলাকায় আইআরজিসি’র ঘাঁটিতে অবতরণ করি।

সেখানে আমি সব যোদ্ধাকে প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পাই। আমি তাদের জানাই যে, পথে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সেনাদের অগ্রসরমান দেখে এসেছি। আমি আরো জানাই, কোবরা হেলিকপ্টার কাজে লাগানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আমি  সেনাবাহিনীর একদল পাইলটকে নিয়ে অভিযানে নেমে পড়ি।  আমরা দেখতে পাই পিপলস মুজাহেদিনের বিশ্বাসঘাতক ভাড়াটে সেনারা ব্রাজিলে তৈরি অত্যাধুনিক ট্যাংক, ভারী অস্ত্রসস্ত্র, ফিল্ড হাসাপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গে করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পথে তারা বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে।  কেরমানশাহ প্রদেশের ইসলামাবাদ শহরে তারা ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইসলামাবাদ থেকে তারা কেরমানশাহ শহরে আসার পথে চরজাবার এলাকায় ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

এখানে প্রচণ্ড সংঘর্ষে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর প্রায় দেড় হাজার সন্ত্রাসী নিহত হয় এবং জীবিতরা প্রাণ নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে যায়। এ সময় ইরানি যোদ্ধারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের মূল দলকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পথিমধ্যে কিছু সন্ত্রাসী ওঁৎ পেতে থাকে এবং কিছুদূর পরপর ইরানি যোদ্ধাদের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। এ সময় ইরাকি বিমান বাহিনীও মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে পশ্চাদ্ধাবনকারী ইরানি যোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায় এবং বহু যোদ্ধাকে শহীদ করে। তা সত্ত্বেও ইরানি যোদ্ধারা প্রথমে ইসলামাবাদ শহর সন্ত্রাসীমুক্ত করেন এবং এরপর কারান্দ শহরের দিকে অগ্রসর হন। তবে ইরানি যোদ্ধারা কারান্দে পৌঁছার আগেই রাত তিনটার সময় তিনটি বড় আকারের ইরাকি পরিবহণ হেলিকপ্টার ওই শহরে অবতরণ করে এবং মাসুদ রাজাভি ও তার স্ত্রীসহ মোনাফেকিন গোষ্ঠীর কমান্ডারদের তুলে নিয়ে যায়। ফলে তারা ইরানি যোদ্ধাদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যায়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ