মার্চ ২৩, ২০২২ ২০:৫৪ Asia/Dhaka

আজ আমরা ইরানের পক্ষ থেকে চালানো মেরসাদ অভিযানে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর নেতা মাসুদ রাজাভি মনে করেছিল, ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে, দেশটির নেতৃত্ব যুদ্ধের ব্যাপারে চরম হতাশায় পৌঁছে গেছে। কাজেই এখন এই গোষ্ঠী হামলা চালালে ইরানি জনগণ তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করবে।  কিন্তু ইরানি গণবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এদেশের সেনা ও বিমান বাহিনী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর অগ্রবর্তী দলেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। অভিযান শেষে কেরমানশাহ থেকে পশ্চিম ইসলামাবাদ শহরে যাওয়ার মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কেবল মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সদস্যদের লাশ ও তাদের সমরাস্ত্রের ধ্বংসস্তুপ পড়ে থাকতে দেখা যায়।  অভিযানে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর ৭২টি ট্যাংক, ২১টি সাঁজোয়া যান, ৫১টি ১০৬ মিলিমিটার বন্দুক ও ৬১২টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এর মাধ্যমে ওই গোষ্ঠীর ইরানবিরোধী অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং ইরানি যোদ্ধাদের মেরসাদ নামের অভিযান সফল হয়।

মেরসাদ অভিযানে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর শতকরা ৩০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার সদস্য নিহত ও অপর এক হাজার ১০০ জন আহত হয়। অভিযান শেষে ইরানি যোদ্ধারা আবার ইরাক সীমান্তে পৌঁছে যান।  মোনাফেকিন গোষ্ঠীর প্রায় এক হাজার সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রায় এক হাজার ১০০ পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। এসব পাসপোর্ট উদ্ধারের ঘটনায় প্রমাণিত হয়, কি জঘন্য মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর এসব সদস্যকে ইরানে আগ্রসান চালাতে পাঠানো হয়েছিল। এই পরাজয় মোনাফেনিক গোষ্ঠীকে এতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে, এর ফলে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। এদিকে ইরাকি শাসক সাদ্দামের সঙ্গে যোগসাজশ করে মোনাফেকিন গোষ্ঠী এমন সময় ইরানের ভেতরে হামল চালাতে আসে যখন ইরান ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ার পর জাতিসংঘ এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প হয়ে ওঠে; যদিও ইরান ও মোনাফেকিন গোষ্ঠী জাতিসংঘের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করে।

এ সময় লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার এক নিবন্ধে কলামিস্ট হারভে মরিস লিখেছিলেন, “পিপলস মুজাহেদিন বা মোনাফেকিন গোষ্ঠী ও ইরাক দৃশ্যত যে কৌশল নিয়েছে তা হলো দু’দেশের সীমান্তে এই গোষ্ঠীর জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা যাতে চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতির সময় তারা শক্তিশালী অবস্থানে থেকে একটি ভূমিকা নিতে পারে।” গার্ডিয়ান পত্রিকার বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্ট এ সময় তার এক লেখায় বলেন, “মাসুদ রাজাভির সমর্থকরা ইরানি জনগণের প্রকৃত অনুভূতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরানি জনগণ পিপলস মুজাহেদিনের মতো উগ্রপন্থিদের প্রতি  ত্যক্ত-বিরক্ত এবং তারা এই গোষ্ঠীকে কখনই মেনে নেবে না। আর মাসুদ রাজাভির সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে তিনি ইরানের এক নম্বর শত্রু  সাদ্দামের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন; আর এটি হচ্ছে তার রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।”

এই বিশ্লেষক এরপর লিখেছেন, “পিপলস মুজাহেদিনের এই পদক্ষেপের ফলে ইরানি জনগণ আবার যুদ্ধ করার মনোবল ফিরে পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণভাবে ইরানের ভেঙে পড়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তা দূর হয়েছে।”

এদিকে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম ভেবেছিল, তার আগ্রাসী বাহিনীর পাশাপাশি মোনাফেকিন গোষ্ঠীর হামলায় ইরান এতটু পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার যেকোনো চুক্তিতে তেহরান অবনত মস্তকে বাগদাদের সব শর্ত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মেরসাদ অভিযানে বিজয়ের মাধ্যমে ইরান আবার প্রমাণ করেছে, এদেশের জনগণ স্পর্শকাতর মুহূর্তগুলোতে দেশ রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। কাজেই একথা বলা যায়, ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের সমাপ্তি সেদিন ঘটে যেদিন ইরাকি বাহিনী আহওয়াজ ও কেরমানশাহ দিয়ে ইরানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

ইরাকি বাহিনী নতুন করে ইরানে আগ্রাসন শুরু করলে ইমাম খোমেনী (রহ.) যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব ফ্রন্টে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এ লাখ ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর এক বিশাল বাহিনী রণাঙ্গণে উপস্থিত হয়।  এত বেশি সংখ্যক মানুষকে সুসজ্জিত করে যুদ্ধে নিয়োজিত করতে সেনাবাহিনী ও আইআরজিসিকে বেশ বেগ পেতে হয়। এ সম্পর্কে একজন সেনা কমান্ডার পরবর্তীতে বলেন, ফ্রন্টের একটি ঘাঁটিতে যেখানে ১০ হাজার সৈন্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানে ১৬ হাজার জনকে জায়গা দিতে হয় এবং বলা হয়, তোমাদের ওখানে আরও চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সবার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বহু যোদ্ধাকে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয়।

ইরান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরও ইরাক ব্যাপকভাবে আগ্রাসন শুরু করার ফলে অনেকগুলো বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যায়। এর আগে আট বছরব্যাপী এ যুদ্ধের আগ্রাসী দেশ হিসেবে ইরাককে চিহ্নিত করার জন্য ইরান যে দাবি জানিয়ে আসছিল তার সত্যতা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিল। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ সময় আহওয়াজে এক জনসভায় বলেন, “আমরা শুরু থেকে বলে এসেছি ইরাক আগ্রাসী দেশ। কিন্তু আমাদের কথা কেউ কেউ বিশ্বাস করেছেন আবার অনেকে বিশ্বাস করেননি। কিন্তু আজ আমাদের সে দাবি সত্য প্রমাণিত হয়েছে।” তবে ইরাক সরকারের আগ্রাসনের কারণেই যে ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সে বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যদি বিষয়টিকে নিশ্চিত করত তাহলে এই বিশ্ব সংস্থা ওই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের জন্য ইরাক সরকারকে দায়ী করে ইরানের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করত।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ