সুখের নীড়- পর্ব ৯
পরিবার ব্যবস্থা মহান আল্লাহর অন্যতম সেরা উপহার। একটি সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে সুন্দর ও সুসভ্য পরিবারের অস্তিত্ব থেকে।
গঠনমূলক চিন্তা ও সুশিক্ষা আর সুন্দর সংস্কৃতিকে তথা উন্নত সভ্যতাকে যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হয় সেজন্যও দরকার পরিবার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। আর পরিবার যদি সুগঠিত ও উন্নত না হয় তাহলে বিজাতীয় সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। আর এ জন্যই সমাজতত্ত্ববিদ, মনস্তত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদসহ সবাই পরিবার-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ওপর খুবই জোর দিয়ে আসছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীও মনে করেন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দিক থেকেও সমাজকে সুরক্ষার এক বড় মাধ্যম হল পরিবার। আর পরিবার ব্যবস্থাই যদি নড়বড়ে হয় বা বিলুপ্ত হয় তাহলে সমাজ থেকে উন্নত নৈতিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধও বিদায় নেবে। ইসলাম বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠনকে এ জন্যই বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
ইসলামী ইরানে পরিবার ব্যবস্থা এখনও বেশ শক্তিশালী। পারিবারিক বন্ধন এই দেশে এক শক্তিশালী ঐতিহ্যের অংশ। পরিবারে স্নেহ-মমতার বন্ধন যে কত শক্তিশালী ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসির সোহরাব-রুস্তমের ঘটনা থেকেও তা বোঝা যায়। ইরানিদের ধর্মীয় বিশ্বাসও পরিবার-ব্যবস্থা শক্তিশালী রাখতে ভূমিকা রেখেছে। মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রেও ইরানিদের জন্য আদর্শ। বিখ্যাত হাদিসে কিসা'র ঘটনাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এই বিখ্যাত পবিত্র হাদিসে রয়েছে নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবীয় শিক্ষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ব্যবহার বা আচরণ, সন্তান ও বাবা-মায়ের সঙ্গে আচরণ, পরিবারের সদস্যদের সম্মান করা –এসবই ইসলামের মহাপুরুষদের জীবনে পরিবার-ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে। ইরানি পরিবারগুলো এইসব আচরণকেই তাদের জন্য শিরোধার্য মনে করে।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী বর্ণনা করেন, রাসুল (সা:) এর কন্যা হযরত ফাতিমাকে (সাঃআঃ) বলতে শুনেছি যে, " একদিন আমার পিতা আল্লাহর রাসুল (সা:) আমার ঘরে আসেন। রাসুল (সা:) আমাকে বললেন, হে ফাতিমা, তোমার উপর সালাম। আমিও তাঁকে বললাম যে, আপনার উপর দরুদ ও সালাম। আমার পিতা বললেন যে, আমি বেশ অসুস্থতা বোধ করছি। আমি বললাম, আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দান করুন। রাসুল (সা:) বললেন, ওহে মা ফাতিমা, আমার ইয়েমেনী চাদরটা দিয়ে আমাকে ঢেকে দাও। আমি ইয়েমেনী চাদরটা দিয়ে পিতাকে ঢেকে দিলাম। তখনই খেয়াল করে দেখলাম যে, রাসুল (সা:) এর পবিত্র চেহারা মোবারক থেকে এমনই নূরের জ্যোতি বের হচ্ছে ঠিক যেন পূর্ণিমার চাঁদের মত লাগছে। এর কিছুক্ষণ পরে আমার প্রথম পুত্র হাসান ইবনে আলী ঘরে ঢুকে আমাকে সালাম দিল। আমিও বললাম , হে আমার নয়ন-মনি, তোমার উপর দরুদ ও সালাম । হাসান বলল, হে আম্মাজন , আমি এখানে আমার নানাজান রাসুলে খোদার (সা:) অতি উত্তম সুঘ্রাণ পাচ্ছি। আমি বললাম, তোমার অনুমান সঠিক। ঐ চাদরের ভিতরে তোমার নানাজান উপস্থিত।
অতঃপর হাসান ইবনে আলী চাদরের কাছে আসেন এবং মহানবীর অনুমতি নিয়ে তাঁর ওই চাদরের ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর রাসুলের অনুমতি নিয়ে হুসাইন ইবনে আলী (আঃ) ও এরপর হযরত আলী ইবনে আবু তালেবও (আঃ) অনেকটা একই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে ওই চাদরের ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রায় একই ধরনের কথোপকথনের পর হযরত ফাতিমাও রাসুলের (সা:) চাদরের ভিতরে প্রবেশ করেন।
এভাবে এই পাঁচজন মিলে চাদরের নীচে একত্রিত হলে রাসুল (সা:) তাঁর ডান হাত দিয়ে চাদরের দুকিনারা ধরে আকাশের দিকে উঠিয়ে বললেন, হে আমার আল্লাহ , এরাই আমার আহলে বাইত, আমার রক্তজ বংশধর, এরাই আমার অস্তিত্ব, আমার রক্ত। যে এদেরকে দুঃখ কষ্ট দেবে সে যেন আমাকেও দুঃখ কষ্ট দেবে। ...যে এদের শত্রু আমিও তাদের শত্রু। যে এদেরকে ভালবাসবে আমিও তাদেরকে ভালবাসব। ... হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ, তোমার রহমত, তোমার পুরস্কার , তোমার দয়া, তোমার বরকত - তুমি আমার ও আমার এই আহলে বাইতের জন্য ধার্য করে দাও। এদের কাছ থেকে সকল প্রকার অপমান ও অপবিত্রতা দূরে রেখ এবং এদেরকে পুতঃপবিত্র রেখ যতটা পুতঃপবিত্র রাখার হক আছে ।
হাদিসে কিসার ঘটনার নানা অংশে আমরা দেখতে পাই মহানবীর পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সালাম দিচ্ছেন ও সর্বোত্তম ভাষায় সালামের জবাব দিচ্ছেন ও পরস্পরের প্রতি দরুদ পেশ করছেন সর্বোত্তম শব্দ ব্যবহার করে। এখানে দেখা যায় বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের কথা বা সম্বোধনে সর্বোত্তম শ্রদ্ধাবোধ এবং এমনকি এতে সন্তানসুলভ আবেগের কারণে মা, বাবা ও নানার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কিংবা মা, বাবা অথবা নানার পক্ষ থেকেও সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা যায়নি। এই হাদিসের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে মহানবীর (সা) কাছে যেতে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরাও তাঁর কাছে অনুমতি চেয়েছেন! এমনকি এক্ষেত্রে মহানবীর কন্যা হযরত ফাতিমাও বাবার অনুমতি চেয়েছেন এবং তাঁর চেহারাকে সুন্দরতম ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
মহানবী –সা তাঁর দুই নাতিকেও এখানে সুন্দরতম ভাষায় বা উপাধিতে সম্বোধন করে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। যেমন, তিনি ইমাম হাসান ও হুসাইনকে (আ) বলেছেন, হে আমার সন্তান, তোমার উপরেও দরুদ ও সালাম রইল। হে কাওসারের সন্তান, হে জান্নাতের যুবকদের সর্দার!... হে আমার সন্তান, আমার উম্মতের শাফায়েতকারী, তোমার উপরেও দরুদ ও সালাম রইল । হে কাওসারের সন্তান, হে জান্নাতের যুবকদের সর্দার!... হযরত ফাতিমাকেও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মধুর উপাধি দিয়ে সম্বোধন করে মহানবী (সা) বলেছেন, হে আমার কন্যা এবং হে আমার অস্তিত্বের অংশবিশেষ!...এখানে পিতা ও কন্যার সর্বোচ্চ স্নেহের বন্ধনের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। পিতার অনন্য সেবার জন্য হযরত ফাতিমার অন্যতম বড় উপাধি হয় উম্মে আবিহা তথা নিজের পিতার মাতা। হাদিসে কিসায় তিন জন ইমাম ও দুই জন ইমামের মাতা ও রাসুলে খোদার উপস্থিতি তথা তিন প্রজন্মের ৫ জন অনন্য ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি চিরস্মরণীয়। হযরত ফাতিমা গৃহিণী হয়েও রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন। পরিবার ব্যবস্থায় তাঁর ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয়। বিশ্ব-ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী এই পরিবার বিশ্বের সর্বকালের সেরা তথা পরিপূর্ণ আদর্শ মানব-পরিবার!
মহানবীর পরিবারের সব সদস্য সামষ্টিক জীবনে ভূমিকা রেখেছেন কোনো টেনশন ছাড়াই। এই পরিবারে সন্তানদের উপস্থিতি পারস্পরিক স্নেহ-মমতায় ও আন্তরিকতায় বাধা হয়ে উঠেনি কখনও। ডক্টর আরমাকির মত কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব এই পরিবারকে গতিশীল আনবিক পরিবার বলে উল্লেখ করেছেন। মুসলমানদের ও ইরানি মুসলমানদের পরিবার ব্যবস্থায় মহানবীর পরিবারের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এসব পরিবারে স্নেহ-মমতা, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্ব, মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, আনুগত্য, সামাজিক দায়িত্ববোধ, স্নেহময়ী বোনের ভূমিকা ইত্যাদি খুবই প্রোজ্জ্বল! ইরানিদের পরিবারের সদস্যদের নামকরণে মুহাম্মাদ, আলি, ফাতিমা এবং হাসান ও হুসাইন নাম সবচেয়ে জনপ্রিয়। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।