মার্চ ২৯, ২০২২ ১৯:৩৮ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সেমনান প্রদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত শহর শাহরুদের বিখ্যাত আব্‌র জঙ্গলে গিয়েছিলাম। পঁয়ত্রিশ হাজার কিলোমিটার এই বনের আয়তন। মনে রাখা দরকার যে হিরকানি জঙ্গলগুলো জুরাসিক যুগের নিদর্শন। বরফ যুগেও এই বনগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নি। এ কারণে আব্র জঙ্গলের গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

যাই হোক শাহরুদ শহর ভ্রমণ ও পরিদর্শনের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা সুন্দর শহর "বাস্তম" পরিদর্শনে যাবো। ইরানের ইতিহাসে সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই এলাকার গুণীজনদের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করে। বাস্তমের ইতিহাস বিশেষ করে দুই মহাপুরুষের নামের সাথে বাঁধা। একজন "বায়জিদ বাস্তমী" এবং  আরেকজন "শেখ আবুল হাসান খারকনি"।

শাহরুদ শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বাস্তম শহরটি অবস্থিত। শাহরুদের পার্শ্ববর্তী এই শহরটি পূর্ব আলবোর্জের জলময় সবুজ  উপকূলে অবস্থিত। বাস্তম শহরটি বেশ পুরনো। বলা হয়ে থাকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ সহস্রাব্দের ঐতিহাসিক শহর এটি।  শহরের বর্তমান যে অবকাঠামো তা সেই সময়ের প্রাচীন ভিত্তির উপরই নির্মিত হয়েছে। ইসলাম-পরবর্তী বিভিন্ন সময়-পর্বে এই শহরটিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সাহিত্য সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভৌগোলিক দিক থেকেও এই শহরের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বাস্তম শহরটি খোরাসান এবং মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিম ইরান ও ইউরোপের দিকে যাওয়ার ক্রসিং পয়েন্টে পড়েছে। এই শহরের বিশ্ব খ্যাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। তাছাড়া এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বায়েজিদ বাস্তমির মাজারটিও এই শহরে অবস্থিত। বলা যেতে পারে এই মাজারের অবস্থানের কারণে বাস্তম শহর বিশ্বের সেরা আধ্যাত্মিক ও পর্যটন শহরে পরিণত হয়েছে।

শাহরুদে "বায়জিদ বাস্তমী'র মাজার 

"বায়জিদ বাস্তমি" সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বাস্তম শহরের অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এই সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সটি বেশ বড়োসড়ো। কমপ্লেক্সের  ভেতরে রয়েছে বিচিত্র স্থাপনা যেমন মসজিদ, সমাধি, গম্বুজ, মিনার, বারান্দা, করিডোর এবং আঙ্গিনা। এতে খ্রিস্টীয় এগারো থেকে বারো শতকের সেলজুকি স্থাপত্য নিদর্শন, তেরো থেকে চৌদ্দ শতকের ইলখানি শাসনামলের নিদর্শন, চৌদ্দ থেকে ষোলো শতকের তৈমুরীয় নিদর্শন, ষোলো থেকে আঠারো শতকের সাফাভি শাসনামলের নিদর্শন এবং উনিশ থেকে বিশ শতকের কাজার শাসনামলের বিচিত্র নিদর্শন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে সুদূর অতীতে পদার্পণ করেছেন। এখানকার পুরো কমপ্লেক্সের পরিবেশ বেশ প্রশান্তিদায়ক ও স্বস্তিদায়ক। পাখির গানের আওয়াজ শুনতে শুনতে উপরে তাকালে নজরে পড়বে নীল আকাশ, চারপাশে রঙিন গাছ, পুরানো এবং সবুজ গাছ। আর অনন্য টাইলসের কারুকাজ-সব মিলিয়ে পুরো কমপ্লেক্সটিকে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে খুব সহজেই।  বায়েজিদ বাস্তমি হিজরি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শতকের একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর জীবনী সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাঁর বক্তব্যসমূহ কিংবা তাঁর সম্পর্কিত বিচিত্র তথ্যপঞ্জি ও নিদর্শন থেকে মনেকরা হয় আধ্যাত্মিক প্রেম তাঁর কাছে একটা বিশেষ মর্যাদার বিষয় ছিল। তাসাওউফের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ইরানের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তিত্ব। এ কারণেই তাঁকে 'সুলতানুল আরেফিন' মানে অধ্যাত্মবাদীদের সম্রাট বলে অভিহিত করা হতো। তাঁর কথাবার্তা, আচার আচরণ এবং তাঁর জীবনের গল্পসমূহ অন্যান্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের তুলনায় কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার এবং মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির কবিতায় অনেক বেশি বর্ণিত হয়েছে।

সমাধিতে প্রবেশ করার সময় এর সরল স্বাভাবিকতা এবং অন্তরঙ্গ সুষমা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। মাজারটি একেবারেই সাধারণ তবে নজিরবিহীন পবিত্র। এ থেকে এই মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের বিশুদ্ধ ও নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ ফুটে ওঠে। বায়েজিদ বাস্তমীর কবরের ওপর একটি সাধারণ সাদা পাথরে সুন্দর অক্ষরে খোদাই করে লেখা রয়েছে তাঁর নাম। মাজারের বাম দিকে একটি করিডোর রয়েছে। ওই করিডোরে রয়েছে পুরোনো কিছু চিত্রকর্ম। এসব চিত্রকর্ম প্রকৃতপক্ষে এই মাজার সংক্রান্ত বিচিত্র স্মৃতির অ্যালবাম। এই বিভাগে বিভিন্ন সময় ও যুগপর্বে ধারণকৃত মাজারের ঐতিহাসিক ছবিগুলোও দেখতে পাওয়া যাবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাঁর কবরটি মূল স্থাপনার বাইরে এবং উঠানের পাশে অবস্থিত। এই মাজারের পাশেই একটি ইবাদাতখানা লক্ষ্য করা যাবে। ওই ইবাদাতখানায় বায়েজিদ বাস্তমি ইবাদাত করতেন। এই স্থাপনাটি প্রমাণ করছে যে তিনি একেবারেই সাদাসিধে, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। কোনোরকম জাঁকজমক বা জমকালো কোনো আয়োজন তাঁর জীবনে ছিল না। ইবাদাতখানার দেওয়ালগুলোর কোথাও কোথাও চকের কাজ করা হয়েছে। দমগনের নামকরা স্থপতিরা হিজরি সাত শ দুই সালের দিকে এই কাজগুলো সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিয়েছিল। মেহরাবের উপরে সোলস ফন্টে পবিত্র কুরআনের সূরা হুদের এক শ চৌদ্দ নম্বর ও এক শ পনেরো নম্বর আয়াত দুটোর ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। ওই ক্যালিগ্রাফিগুলোর শিল্পমূল্য শিল্পীমাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন।#          

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ