মার্চ ৩১, ২০২২ ২০:৪১ Asia/Dhaka

ইরাকের সাদ্দাম সরকার যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার পরবর্তী প্রায় দেড় বছর বাগদাদ ও তেহরানের মধ্যকার আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। কারণ, ইরাকি স্বৈরশাসক আট বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যা কিছু অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তার সবকিছু এই আলোচনার মাধ্যমে অর্জন করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু দেড় বছর পর হঠাৎ করে সাদ্দাম তার অবস্থান পরিবর্তন করে অনেকটা নমনীয় আচরণ করতে শুরু করেন।  ইরাকি শাসক ১৯৯০ সালের ২১ এপ্রিল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখে দু’দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব করেন। তিনি ইরান ও ইরাকের মধ্যকার মতবিরোধ দূর করার জন্য মক্কা মুকাররমা বা অন্য কোনো স্থানে এই আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

সাদ্দাম তার চিঠিতে লেখেন: আমার দৃষ্টিতে আমরা যদি সরাসরি আলোচনায় বসি তখন ইরাক ও ইরান যা কিছুকে নিজেদের অধিকার মনে করে তার সবই অর্জন করা সম্ভব। আমার মনে হয় আলোচনার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে ইরাকের পক্ষ থেকে তেহরানে একজন প্রতিনিধি এবং ইরানের পক্ষ থেকে বাগদাদে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত হবেন। সাদ্দামের এই চিঠির জবাবে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি ১৯৯০ সালের ২ মে ইরাকি শাসক সাদ্দামকে লেখেন: আপনার চিঠিতে যা কিছু লেখা হয়েছে তা যদি আট বছর আগে লিখতেন এবং সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর পরিবর্তে এই চিঠিটি পাঠাতেন তাহলে ইরান ও ইরাকসহ মুসলিম বিশ্বের এত অপূরণীয় ক্ষতি হতো না।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি দু’দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উত্থাপন করা যেকোনো প্রস্তাব মেনে নিতে তেহরানের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে বলেন, এখনো ইরাকের দখলে ইরানের কিছু ভূখণ্ড থাকার কারণে দু’দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা সুদূর পরাহত বলে মনে হচ্ছে।  ইরানের প্রেসিডেন্ট বিগত আট বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে সাদ্দামকে বলেন: চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধ সবচেয়ে আশাহত ব্যক্তিকেও একথা শিখিয়েছে যে, ইরানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে যে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দুর্বল করা যাবে না।  প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি সাদ্দামকে লেখা চিঠিতে আরো বলেন, দু’দেশের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে আলোচনার আগে ইরান ও ইরাকের প্রতিনিধিরা তৃতীয় কোনো দেশে আলোচনায় বসুক এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের ভিত্তিতে মতবিরোধ নিরসনের চেষ্টা করুক।

ইরানের জবাব পাওয়ার পর সাদ্দাম ১৯৯০ সালের ১৯ মে ইরানের কাছে আরেকটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি জেনেভায় ইরান ও ইরাকের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন এবং একইসঙ্গে দু’দেশের শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাতের দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে  চলারও প্রতিশ্রুতি দেন। ইরাকি শাসকের প্রস্তাব অনুযায়ী মে মাস থেকে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত জেনেভায় ইরান ও ইরাকের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলতে থাকে। এ আলোচনা চলার সময় দু’দেশের প্রেসিডেন্টরা পরস্পরকে চিঠি পাঠাতেন ও তার জবাব দিতেন। প্রতিটি চিঠিতে এক ধাপ করে অগ্রগতি অর্জিত হতো। ইরান একেকটি চিঠিতে একেক ধাপ অগ্রসর হতো আর সাদ্দাম একেক ধাপ পেছনে সরে যেতেন। এক সময় বোঝা গেল, সাদ্দাম ইরাক-ইরান উত্তেজনা প্রশমন করে অন্য কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান এবং তা করতে চান দ্রুততম সময়ের মধ্যে। আর ওই পরিকল্পনা ছিল কুয়েত দখল করা।

১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকি বাহিনী ভোর ২টা থেকে শুরু করে সকাল ৮টার মধ্যে অর্থাৎ মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে কুয়েত দখল করে। এর মাধ্যমে গত কয়েক দশকের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী একটি ঘটনার বীজ বপন করা হয়। ইরাক রাতের অন্ধকারে কোনো ঘোষণা ছাড়াই ৯৫ হাজার সেনাকে কুয়েতের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় এবং কুয়েতি জনগণ সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখে তাদের দেশ বেদখল হয়ে গেছে। ইরাকি বাহিনীর মোকাবিলায় কুয়েতের সর্বসাকুল্যে ২০ হাজার সৈন্য কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টাই করেনি। ইরাক কুয়েতকে নিজের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে এবং কয়েকটি দ্বীপসহ দেশটির ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি ও ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এর ফলে ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইরাকের অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরাকের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া, সে সময় কুয়েতের ১০ হাজার ৯০০ কোটি ব্যারেল তেলের ভাণ্ডারকে হিসাব করে ইরাক মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী দেশে পরিণত হয়। ইরাকের এই আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে ইরান এই সংঘাতে নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে।প্র তিবেশী একটি দেশ দখলের ইরাকি এই তৎপরতা সমর্থন করা ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের সময় কুয়েত বাগদাদকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান এবার প্রতিশোধ নিতে চায়নি। এমনকি ইরাক কুয়েতে আগ্রাসন চালালে বহু কুয়েতি নাগরিক পালিয়ে ইরানে আশ্রয় গ্রহণ করে।

ইরাকি শাসক সাদ্দাম তার আগের দু’টি চিঠির জবাব তখনও পাননি। কিন্তু তারপরও তিনি কুয়েত দখলের পরদিন ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট ইরানের প্রেসিডেন্টকে আরেকটি চিঠি লেখেন যাতে বলা হয়: তেহরানের সঙ্গে পরিপূর্ণ শান্তি স্থাপনে বাগদাদ বদ্ধপরিকর এবং এ ব্যাপারে ইরাক সরকার ইরানের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী। সাদ্দামের এই চিঠি থেকে বোঝা যায়, কুয়েত দখল করে তিনি যখন বিপদে পড়েছেন তখন ইরান যাতে এই সুযোগে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সেজন্য তিনি ইরানকে যেকোনো কিছু দিয়ে দিতে রাজি আছেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ