কি হতে যাচ্ছে পাকিস্তানে
'পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা বড় ধোঁয়াটে'
পাকিস্তানে কি হতে যাচ্ছে! নানা নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন আজ স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শুরু হয়ে এখনও চলছে। ইমরান খানের ওপর অনাস্থা ভোটাভুটি রাত ৮টার পর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপেক্ষার পালা। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের নানা দিক নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. আকমল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছি।
অধ্যাপক আকমল বলেছেন, আসলে পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব জটিল। পুরো বিষয়টি ধোঁয়াশাপূর্ণ। সেখানে রাজনীতি এবং সরকারের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর প্রভাব সব সময়ই ছিল। তারা এরকম পরিস্থিতিতে ক্ষমতাও গ্রহণ করেছে। সেই সাথে পাশ্চাত্য এবং আমেরিকার প্রভাব ও সম্পৃক্ততার প্রশ্ন তো আছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ,উপস্থাপনা এবং প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, অধ্যাপক আকমল হোসেন, পাকিস্তানে সম্প্রতি অনেক কিছু ঘটে গেল। বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব, পার্লামেন্টে খারিজ, প্রেসিডেন্টের পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া এবং বিরোধীদের আদালতে যাওয়া, আদালতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এখনও চলমান সেখানকার সংকট। পাকিস্তানের এই সংকট সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব সময়ই একটা রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকা দেশ। আমি বলতে চেয়েছি রাজনৈতিকভাবে দেশটিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি কখনই শক্তিশালী হতে দেখি নি। যদিও নির্বাচন হয়েছে কিন্তু নির্বাচিত সরকার বেশি দিন টেকেনি। এ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে নি। সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। আবার নির্বাচন হয়েছে। এভাবেই দেশটি চলছে। তো এবার ইমরান খানের যে সরকারটি ক্ষমতায় ছিল একার্থে এখনও ক্ষমতায় আছে। সেই সরকারটি ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সরকার গঠনের পর এই তিন বছরে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো সরকারের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিল না। তারা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। তারা ইমরান খান সরকারের নীতি, অর্থনীতির তীব্র সমালোচনা করে বলেছে এসব গঠনমূলক ছিল না। তারা পররাষ্ট্রনীতিরও সমালোচনা করেছে। এককথায় তারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আস্থাহীনতা প্রকাশ করেছে। ভোট অব নো কনফিডেন্স এর একটা মোশন আনবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেখা গেল সংসদে স্পিকার সেটি সংবিধানবিরোধী বলে খারিজ করে দেয়। তারপরই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে তাঁর মাধ্যমে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছে। তারপর নতুন নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দল এটাকে অসাংবিধানিক কাজ হয়েছে বলে এর তীব্র সমালোচনা করে বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেছে।
সুপ্রিমকোর্ট গত বৃহষ্পতিবার ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব বাতিল ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। একইসঙ্গে পার্লামেন্ট পুনর্বহালেরও নির্দেশ দেয় বিচারপতিদের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। সর্বোচ্চ আদালাতের রায় অনুযায়ী, আজ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হয় জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ফলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
দেখুন, পাকিস্তানে গত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে সবসময়ই একটা রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে একটি সুস্থ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়নি। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সরকার কিংবা রাজনীতিতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখে এসেছে সবসময়ই।
রেডিও তেহরান: জ্বি অধ্যাপক আকমল হোসেন, আপনি বলছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী একটা অপ্রকাশ্য ভূমিকা রেখে এসেছে সবসময়। তো পাকিস্তানে - রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সেনাবাহিনী এই দুই ইস্যুতে দেশটির ভেতরে বাইরে সতর্ক আলোচনা সমালোচনা চলছে। তো এ দুটো বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: জ্বি দেশটির সরকার গঠনে এবং রাজনীতির নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সবসময় লক্ষ্যণীয়। ইমরান খানও আস্থাভোট মোকাবিলার আগে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। ইমরান খান স্বেচ্ছায় ক্ষমতায় ছেড়ে দিচ্ছে নিশ্চয়ই এমনটি না। বিরোধীরা যখন সুপ্রিমকোর্টে গেছে তখন দৃষ্টি সবার সেদিকে ছিল। পাকিস্তানে যখন বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয় তখন দেখা গেছে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এরকম একটা সম্ভাবনাও কিন্তু পাকিস্তানের বিষয়ে বলা যায়। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং কি হবে সে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা যায় না। একথাও বলা যাবে না- ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার নতুন করে তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন! পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা বড় ধোঁয়াটে বলে আমার কাছে মনে হয়।
শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা পাকিস্তান সংকট নিয়ে সাক্ষাৎকার শুনছিলেন। ফিরছি শিগগিরিই। আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: ড. আকমল হোসেন, সেনাবাহিনী এবং বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষসহ পাকিস্তানে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছে আমেরিকা -এই অভিযোগ তুলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এ বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট একজন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- সরকার উৎখাতের এই প্রচেষ্টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, পাকিস্তানসহ আমাদের মতো দেশগুলোতে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক যখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে বিরূপ অবস্থায় চলে যায় তখন অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি সংযোগ ঘটে কিংবা বিদেশির হস্তক্ষেপকে টেনে আনা হয়। অতীতেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। ইমরান খান যখন অভিযোগ তুললেন যে বিদেশিরা ষড়যন্ত্র করছে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার। তিনি স্পষ্ট করে আমেরিকার কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি একটু আগের কথা বলতে চাই। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করল ঠিক তার আগেই ইমরান খান রাশিয়া সফর করলেন। সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার সময়ও সম্ভবত তিনি রাশিয়াতে ছিলেন। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানে থাকা বিদেশি কূটনীতিকরা একটা বিবৃতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছিল। এখানে বোঝা যাচ্ছে ইমরান খানের ইউক্রেন নীতি নিয়ে পাশ্চাত্য সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেটি হচ্ছে ইমরান খান কোন পর্যায়ে পাশ্চাত্যের স্বার্থকে বিবেচনায় নিলেন না; সেটিও বিবেচনার বিষয়। ইমরানের পরিবর্তে অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে তাতে আমেরিকার লাভের পরিমাণটা কি বেশি হবে অথবা ক্ষতি হবে- এ বিষয়টি কিন্তু আমার কাছে খুব বেশি পরিষ্কার না।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আকমল হোসেন, আপনি বলছিলেন পাকিস্তানে আমেরিকার নাগ গলানোর লাভ ক্ষতি কি! একটু পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে-পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার লাভের অনেক কিছু আছে। তালেবান ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। এর আগেও যখনই পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে আঙুল উঠেছে আমেরিকার দিকে। তো সবকিছু মেলালে বিভিন্নমুখী বিষয় এখানে দেখা যায়-যদি এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলেন?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, আমেরিকার স্বার্থ এখানে রয়েছে। দেশটি এখানে সম্পৃক্ত। এখন ইমরান খান কোন পরিস্থিতিতে এবং কি করেছে যে জন্য আমেরিকা আশাহত হয়েছে! আমরা দেখ লাম, ইমরান শুধু রাশিয়া সফর করেছেন। অন্যদিক দিয়ে আপনি যে বললেন তালেবান ইস্যুতে আমেরিকার কাছে কিন্তু পাকিস্তানের বেশ মূল্য রয়েছে। বলা যেতে পারে এক্ষেত্রে পাকিস্তান হচ্ছে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মাধ্যম। পাকিস্তানের সাথে বর্তমান তালেবান নেতাদেরও যোগাযোগ আছে। সুতরাং আমেরিকাকে ঐ বিবেচনাটাও করতে হবে। ইমরানের পরিবর্তে আরেকজন এসে সেই কাজটি কতোটা করবে সেটাও দেখার বিষয়!
অধ্যাপক, ড আকমল হোসেন, সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, মার্কিন বলয় থেকে পাকিস্তানের এই সরে আসার ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী প্রভাব ফেলবে? -এর গুরুত্বই বা কী?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: পাকিস্তান বরাবরই আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান বরং ভারতের চেয়ে বেশি মিত্র ছিল আমেরিকার। তখন বিভিন্ন রকম সামরিক চুক্তি, প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। তবে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যে কারণে আমেরিকা আগের মতো পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে না। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পড়বে এমনটি মনে হয় না। আমি যেটি বলতে চাইছি সেটি হচ্ছে, পাকিস্তানে যেই সরকারে থাকুক সেখানে যদি আমেরিকার ইনফ্লুয়েন্স থাকে সেটি তো তাদের জন্য ভালোই। অর্থাৎ নতুন যারা আসবে তারাও যদি আমেরিকার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় সেটা তো আমেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তবে ইমরান খান যে সংকটে পড়েছে সেটি অত্যন্ত জটিল। রাশিয়া আবার যদি ইমরান খানের পক্ষ নেয়! তবে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রকাশ্য অবস্থান অবশ্য আমরা এর আগে দেখি নি। তবে এখন সেটা হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ ঘটনা কি প্রভাব ফেলছে সেটা এখনই বোঝা মুশকিল।
তো অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন-পাকিস্তান সংকট নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৯